ঢাকা: খরা মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির, আর বর্ষা এলেই অযাচিত প্লাবন। এতে প্রতিবছরই ভাঙে মানুষের চাষের জমি ও ভিটেমাটি। তিস্তা প্রতিবছরই কেড়ে নেয় সাধারণ মানুষের সর্বস্ব। তাই ভিটেমাটি হারিয়ে বছরের পর বছর উদ্বাস্তু হয়ে ঘুরছে তিস্তা চরের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তায়বায়নের মাধ্যমে মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন হবে- এই আশা নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে এলেও বারবার তা হতাশায় পরিণত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভৌগলিক অবস্থানগত রাজনীতির শিকার ও জলবায়ুর প্রভাবের কারণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তবে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন করে স্বপ্ন দেখছে তিস্তা চরের মানুষ। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে চীন।
গত মার্চে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের পর তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে চীন সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তিস্তাপাড়ের আশেপাশে এক হাজার শয্যার একটি আধুনিক মানের হাসপাতাল তৈরি করবে। সেই হাসপাতাল তৈরির কাজও প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছে। জমি দেখার কাজও শেষ। সেইসঙ্গে তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাকি কাজগুলোর দিকেও নজর দিতে শুরু করেছে।
তিস্তার চরের মানুষদের স্বপ্ন- সেখানে আধুনিক বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও খেলার জায়গা থাকবে। পাশাপাশি থাকবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাকরির ব্যবস্থা। যুগ যুগ ধরে চর ও তিস্তাপাড়ের মানুষগুলো অবহেলিত জীবন যাপন করেছে। কোনোদিনই তাদের আয়-উন্নতি তেমন একটা ছিল না। সবসময় দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেছে। এখন তারা ঘুরে দাঁড়াতে চায়।
তিস্তা নিয়ে গবেষণা করেন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মির্জা মো. নাসির উদ্দিন। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘তিস্তা চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের দুঃখ-কষ্টের সীমা-পরিসীমা নেই। প্রায় ২৩ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে দারিদ্রের হার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অতি দরিদ্রের হার ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ। তিস্তার আশেপাশের জেলাগুলোর অধিকাংশ চর স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের আওতায় আসেনি। যে কারণে চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, “এ অঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ‘চরের জীবন পরের জীবন’। অর্থাৎ কুড়িগ্রামের চরের মানুষের জীবন ও জীবিকা অন্যের ওপর নির্ভর করে, অথবা দয়ায় পরিচালিত হয়। কুড়িগ্রামসহ সারাদেশের চরাঞ্চলে প্রায় ১০ মিলিয়ন সহায়-সম্বলহীন মানুষের বাস। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগের এক ভাগ। উন্নয়নের জন্য চরকেন্দ্রিক একটি আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন বর্তমান প্রেক্ষাপটে অতি প্রাসঙ্গিক। পৃথিবীতে এ সংক্রান্ত নিদর্শন এবং দৃষ্টান্তও রয়েছে।’
এই আধুনিক যুগে এসেও তিস্তা চরাঞ্চলের মানুষ ভালোভাবে বাস করতে পারে না। বন্যায় সবকিছু কেড়ে নেয়। আবার শুকনো মৌসুমে সবকিছু ধুধু বালুচরে পরিণত হয়। এখন বদলে দেওয়ার সময় এসেছে। এসেছে পরিবর্তনের সময়।
কৃষি বিজ্ঞানী ড. মাকসুদ কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘জলবায়ুর প্রভাবের কারণে প্রতিবছর যে ক্ষতি হয় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তা থেকে উত্তরণ হতে পারবে কৃষকরা। ফলে কৃষি জমিতে আবাদের পরিমাণ বাড়বে। মানুষজনের আর্থিক ক্ষতিও আর হবে না। তিস্তা পরিকল্পনা এই অঞ্চলের প্রাণের দাবি। এটি বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে যুগের পর যুগ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে দেয়নি পাশ্ববর্তী দেশ ভারত। এখন সময় এসেছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের।’