ঢাকা: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ছয় দফা; এর পর ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২০২৪ এর ফ্যাসিবাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থাসহ সব আন্দোলনেরই সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের স্বাধিকার আদায়ের সচেতনতা থেকেই প্রতিবাদ ও দাবি আদায়ের মঞ্চ হিসেবে দেশব্যাপী খ্যাতি পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এখন এই খ্যাতি বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বহিরাগত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক নানান দাবি-দাওয়া নিয়ে ক্যাম্পাসে নিয়মিতই আন্দোলন-সংগ্রাম ও অনুষ্ঠান করতে দেখা যায় নানা সংগঠন ও গোষ্ঠীকে। বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে চলে কোনো না কোনো আন্দোলন, মানববন্ধন অথবা সমাবেশ। এমনকি কোনো কোনো সময় দুই/তিনটি কর্মসূচি একসঙ্গে চলতেও দেখা গেছে।
ঢাবি প্রশাসন জানায়, ক্যাম্পাসে এসব কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই নেওয়া হয় না অনুমতি। নিয়মিত নানারকম আন্দোলন-সমাবেশের ফলে নিরাপত্তাশঙ্কাসহ নানারকম অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এগুলো দেখার কেউ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইরের যানবাহন (অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া) নিয়ন্ত্রণের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকলেও বহিরাগত প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো ব্যবস্থা। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিছু চেকপোস্ট থাকলেও অধিকাংশই থাকে খোলা।
সম্প্রতি ঢাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইয়ার) এর ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী ও স্যার এফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য সম্পাদক শাহরিয়ার সাম্যর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের মধ্যে ‘ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের অপরাধসমূহ’ বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে প্রক্টর দফতর। নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এলাকায় সভা-সমাবেশ করতে হলে প্রক্টরের দফতর থেকে পূর্বানুমতি নিতে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা-সমাবেশ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দফতরের অনুমতি নেয় কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক প্রক্টর ড. সাইফুদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেউ-ই না। কোনো সংগঠনই অনুমতি নেয় না। কিছু সংগঠনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা থাকে। তাই তাদের বাধা দিতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ইস্যুতে ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ করুক তাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে বাইরের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ করাটা যৌক্তিক নয়। শিক্ষার্থীদের জনমত গড়ে উঠলে এ বিষয়ে দ্রুতই আমরা ব্যবস্থা নেব। এভাবে আর বেশি দিন চলতে দেওয়া হবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তামিম আল রাজি মনে করেন জাতীয় ও ব্যক্তিগত দাবি-দাওয়াগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে না করে অন্যত্র করা উচিত। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের দাবি-দাওয়াগুলো বিশাল পরিসরে প্রচারের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে না এসে জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং সংশ্লিষ্ট দফতরের সামনে হতে পারে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সম্মানের সঙ্গে তাদের জানাতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ অব্যাহত রাখতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’
চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি এনসিটিবি’র সামনে আন্দোলনরত ‘আদিবাসী’ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সংগঠন নয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, “১৫ জানুয়ারি ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সংগঠন নয় এবং এর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। হামলার সঙ্গে জড়িত ওই সংগঠনের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনতিবিলম্বে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-বহির্ভূত হামলাকারীদের বিরুদ্ধেও যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
এ ঘটনার ৪ মাস না পেরোতেই গত ১১ মে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) কার্যক্রম নিষিদ্ধসহ পাঁচ দফা দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’।
১৬ জানুয়ারি ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গা। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি ১৫ তারিখে যেভাবে হামলার শিকার হয়েছি তা ছিল পরিকল্পিত। যারা আমাকে মেরেছে তারা বেশিরভাগ বহিরাগত। কিন্তু যেভাবে উনারা আমাকে টার্গেট করেছে তাতে মনে হয়েছে, উনারা ঢাবিতে যেকোনো সাধারণ শিক্ষার্থীদের গতিবিধি সম্পর্কে বেশ সচেতন।’
শ্রেষ্ঠা আরও জানান, ‘আমার ওপর হামলার ঘটনায় উগ্রবাদী ঢাবি শিক্ষার্থীদের ইন্ধন ছিল, যারা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে নানাধরনের উগ্র কার্যকলাপ পরিচালনা করে। এই উগ্র কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বহিরাগতরা উগ্র ব্যক্তিদের ক্যাম্পাসে জড়ো করে। যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। সাধারণ শিক্ষার্থী, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থেই বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে অবাধে চলাচলের বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া উচিত।’
ওই হামলায় আহত হয়েছিলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী নওরিন সুলতানা তমা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ- রাজু ভাস্কর্য সংরক্ষণ, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও হামলাকারী সংগঠনের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিন। রাজু ভাস্কর্য আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে নারীরা বহিরাগতদের দ্বারা অনেক সময় লাঞ্ছনার শিকার হয়। এসব ঘটনা ঘটলে প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’র কর্মসূচি ইস্যুতে ঢাবি প্রক্টর সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে ‘নিরুপায়’ হওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, ‘তারা সেদিন সংবাদ সম্মেলন করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের জানানো হয়নি, এমনকি অনুমতিও নেওয়া হয়নি। ইউপিডিএফ ইস্যুতে ক্যাম্পাসে কেন সভা করতে হবে?- সেটা বোধগম্য নয়। আবার প্রক্টরিয়াল টিম গেলে দেখা যায় যে, আমাদের কোনো শিক্ষার্থী তাদের সঙ্গে আছে।’