ঢাকা: মাস দশেক আগেও ক্ষমতার মসনদে ছিলেন শেখ হাসিনা। তার ইশারায় চলতো গোটা দেশ। রাজনীতি কিংবা দেশ শাসন; সবখানেই ছিল একক রাজত্ব। অভিযোগ উঠেছে, গদি টিকিয়ে রাখতে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর সরাসরি নির্দেশদাতাও সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনার হুকুমেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ঠেকাতে উঠে-পড়ে লাগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দেশজুড়ে চালানো হয় গণহত্যা। অবশেষে এই ‘মাস্টারমাইন্ডের’ বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে জুনে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, জুলাই-আগস্টে গণহত্যার হুকুমদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। এতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকেও আসামি করা হয়। এখানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গণহত্যার উসকানি-প্ররোচণা, সরাসরি নির্দেশসহ পাঁচটি অভিযোগ এনেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। পাঁচটির মধ্যে দু’টি প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রথমটি হলো- ১৪ জুলাই রাজাকারের বাচ্চা বা নাতিপুতি বলে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে উসকানি দেন শেখ হাসিনা। তার এমন প্ররোচণায় ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। একইসঙ্গে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
দ্বিতীয়টি হলো- সরাসরি নির্দেশ। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সববাহিনীকে হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসিসহ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূলের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। এমন কিছু টেলিফোন কনভারসেশনসহ প্রমাণপত্র হাতে পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। আর এসব অভিযোগ বিশ্লেষণের পরই দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফর্মাল চার্জ দাখিল করবেন চিফ প্রসিকিউটর।
জানা গেছে, গত ১৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগ রুজু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই মাস পর তথা ১৪ অক্টোবর তদন্তকাজ শুরু করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তদন্তে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেশজুড়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, লাশ পুড়িয়ে ফেলাসহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান ‘মাস্টারমাইন্ড’ বা ‘সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে শেখ হাসিনার নাম উঠে এসেছে। আর এসব বাস্তবায়ন করেছেন আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তদন্ত প্রতিবেদনের পাওয়া তথ্যানুযায়ী, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ২৫ হাজারেরও বেশি। বিশেষভাবে সহিংসতা চালানো হয় নারীদের ওপর। টার্গেট করে হেলিকপ্টারে গুলি চালিয়ে শিশুদেরও হত্যা করা হয়। এছাড়া আহতদের হাসপাতালে নিতে বাধাসহ শহিদদের ময়নাতদন্ত করতেও দেওয়া হয়নি।
এমনকি নিজে গিয়েই গুলিবিদ্ধদের সেবা না দিতে চিকিৎসকদের হুকুম দিয়েছেন শেখ হাসিনা। প্রতিবেদনে এ ধরনের আরও তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, আন্দোলনকারীদের ওপর দায় চাপাতে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় নিজেদের লোকদের দিয়ে আগুন লাগানোর নির্দেশও দিয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিচারকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর প্রস্তুতি অনেকটা চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামী জুনের প্রথমার্থে অভিযোগপত্র জমার পরপরই ট্রাইব্যুনাল সন্তুষ্ট হলে শুরু হবে বিচারপ্রক্রিয়া। এর পর পর্যায়ক্রমে সাক্ষ্যগ্রহণের পালা। এসব মামলায় ভুক্তভোগীদের পাশাপাশি সাক্ষী হিসেবে থাকবেন জুলাই আহতদের সেবাদানকারী চিকিৎসকরা। একইসঙ্গে শহিদদের ডেথ সার্টিফিকেট ও আহতদের মেডিকেল সনদ উপস্থাপন করা হবে। শহিদ পরিবারের সদস্যরাও সাক্ষী দিতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের মানুষ চাইছে দ্রুত বিচার শুরু হোক। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সাধারণ কোনো বিষয় নয়। রাজপথের চাপেও এ বিচার করা সম্ভব নয়। এখানে আইনের ও তথ্যানুসন্ধানের বহু খুঁটিনাটি বিষয় রয়েছে। সুতরাং চাপ দিলে এ কাজ সঠিকভাবে করা সম্ভব হবে না। তাই তাড়াহুড়ো নয়, ন্যায়বিচার পেতে অবশ্যই ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টদের সময় দিতে হবে।’
তিনি বলেন, “শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘কমান্ড রেসপনসিবিলিটির’ দায়ে তদন্ত প্রতিবেদন আমরা পেয়েছি। কিন্তু দেশজুড়ে বা অঞ্চলভিত্তিক হওয়া অজস্র হত্যাকাণ্ডের নিখুঁত তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদেরও আমরা বিচারের মুখোমুখি করার কাজটি সম্পন্ন করতে চাই। সে ব্যাপারে তদন্ত সংস্থা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তবে সুপিরিয়র হিসেবে শেখ হাসিনাসহ এই তিনজনের বিরুদ্ধে দ্রুতই ফর্মাল চার্জ দাখিল করা হবে আদালতে। এর মাধ্যমেই আনুষ্ঠানিক বিচারের যাত্রা শুরু হবে।”
উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্টে নৃশংসতার ঘটনায় ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা পড়েছে ৩৩৯টি। প্রায় সব অভিযোগেই রয়েছে শেখ হাসিনার নাম। এছাড়া ২২টি মামলার বিপরীতে ১৪১ জনের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। পরোয়ানা জারির পর গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন ৫৪ জন। আর এখনো পলাতক রয়েছেন ৮৭ জন।