ঢাকা: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে ডাকা ৫ দিনের কলমবিরতি ও আগে থেকে চলমান আন্দোলনে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। অর্থবছরের শেষ দিকের রাজস্বের এই ঘাটতি মোকাবিলায় বেশ বেগ পেতে হবে। তবে দাবি মেনে নিলে অতিরিক্ত সময় কাজ করে রাজস্ব ঘাটতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন এনবিআর কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের এপ্রিলে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। অথচ আন্দোলনের প্রস্তুতি ও জেরে মে মাসের প্রথম ১৮ দিনে মাত্র ৯ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এই গতিতে রাজস্ব আদায় হলে মে মাসের রাজস্ব আদায় হতে পারে ১৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। যেখানে গত বছরের মে মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। ওই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধিসহ আদায় হলে অন্তত ৩৫ হাজার কোটি টাকা আদায়ের কথা। আর ১৮ দিনে প্রবৃদ্ধিসহ আদায় হলে প্রায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হতো। কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী ১১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক সদস্য (আয়কর নীতি) ড. সৈয়দ আমিনুল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজস্বের ওপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আলোচনায় সমাধান হবে। যৌক্তিক সমাধান হলে এনবিআর কর্মকর্তারা এই রাজস্ব ঘাটতি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন।’
এদিকে এনবিআরকে ভাগ করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ জারি করায় রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে। তড়িঘড়ি করে এই অধ্যাদেশ জারি করায় কড়া সমালোচনা করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। এনবিআর সংস্কারের প্রসঙ্গ টেনে তারেক রহমান বলেন, ‘সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার শুরু করেছে। এনবিআর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমাদের হয়তো কারোর-ই কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে তড়িঘড়ি করে সংস্কার শুরু করায় পুরো বিষয়টি হিতে বিপরীত হয়েছে। এনবিআরের কর্মকর্তারা আন্দোলনে থাকায় রাজস্ব আদায়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে চলতি অর্থবছরে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।’
এনবিআরকে বিলুপ্ত করে অধ্যাদেশ জারি করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি)। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তড়িঘড়ি করে অধ্যাদেশ জারি হওয়ায় রাজস্ব ব্যবস্থা নির্বাহী বিভাগের করায়ত্ত্ব হওয়ায় ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। আর এনবিআর ভাগ করার সিদ্ধান্ত সঠিক পদ্ধতি মেনে হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মাননীয় ফেলো (সিপিডি) ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বিগত ১৫ বছরে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রণীত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দুই ভাগ করা ঠিক আছে। এটা আমাদের শ্বেতপত্রে সুপারিশ ছিল। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে, সেটা ঠিক হয়নি। আলোচনা ছাড়া, পেশাজীবীদের জায়গা সংকুচিত ও অন্যান্য অংশীজনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে করা হয়েছে- এটা ঠিক হয়নি। এটাকে এখন ঠিক করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
আরও পড়ুন-
- এনবিআরে ৩ দিনের কলমবিরতি শুরু
- সোমবারও চলবে এনবিআরে কলমবিরতি
- কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন এনবিআর কর্মকর্তারা
- দাবি আদায়ে রোববার পুরো কর্মদিবস এনবিআরে কলমবিরতি
- এনবিআর-এ কলমবিরতি, ক্যাডারের ২ সংগঠনের নেতাদের পদত্যাগ
- রাজস্ব অধ্যাদেশ বাতিলসহ ৩ দাবি এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের
- প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের আশ্বাসে এনবিআরে কলমবিরতি সাময়িক স্থগিত
- অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি, ৩ দিনের কলমবিরতিতে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
- এনবিআর বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত সঠিক, কিন্তু বাস্তবায়ন যথাযথ হয়নি: ড. দেবপ্রিয়
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কর আইনজীবী ফোরামের প্রধান উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজস্ব কর্মকর্তারা এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন। গেল দুই মাস ধরে রাজস্ব আহরণের গতি স্লথ। আগামী বাজেটেও এর প্রভাব পড়তে পারে। কাউকে কিছু না বলে তড়িঘড়ি এই সংস্কারে জাতি অন্ধকারে আছে। সেইসঙ্গে এটা নিয়ে তৈরি হয়েছে ও ধোঁয়াশা। এই অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব আদায়ে বড়ধরনের ধস নামতে পারে।’
তার মতে, এনবিআর সংস্কারের বিষয়টি সরকার তালিকাভুক্ত করে রেখে যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে জাতীয় সংসদে আলোচনার মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্তকরণ কিংবা সংস্কারের উদ্যোগ নেবে। কোনো দেশ কিংবা কারও পরামর্শে দ্রুত এনবিআর সংস্কার করা ঠিক হবে না বলেও মন্তব্য তার।
এদিকে নতুন রাজস্ব অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে টানা পাঁচদিন কলমবিরতি পালন করেছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানিটর সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকে এই কলমবিরতি পালন হয়ে আসছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসতে সম্মত হয়েছেন এমন তথ্য আসে। তবে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না পাওয়ায় ও অর্থ উপদেষ্টার একক বৈঠকের প্রতি আস্থা না পাওয়ায় সোমবারও কলমবিরতি চালিয়ে যান কর্মকর্তারা। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ায় আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।
সোমবারের (১৯ মে) প্রেস ব্রিফিংয়ে ঐক্য পরিষদের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘আমরা প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের সানুগ্রহ নির্দেশানায় সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব পেয়েছি। আগামীকাল ২০ মে (মঙ্গলবার) বিকাল সাড়ে তিনটায় এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। অর্থ উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টামণ্ডলীর কয়েকজন সম্মানিত সদস্য এতে অংশ নেবেন বলে আমরা জেনেছি। বরাবরই বলেছি, আমরা আলোচনার জন্য প্রস্তুত এবং আমাদের একটি প্রতিনিধিদল সে আলোচনায় অংশ নেবে।’
ব্রিফিংয়ে আরও বলা হয়, ‘এই আলোচনার আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কর্মসূচি আগামীকাল সাময়িক বিরতি থাকবে এবং আলোচনার অগ্রগতির ভিত্তিতে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে এ আলোচনা হওয়ার কথা। যেখানে আয়কর ও শুল্কের ১০ থেকে ১২ জন কর্মী অংশ নেবেন।