Thursday 22 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চা শিল্পে সংকট বাড়ছে
কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ ২৪০, বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়!

জুলফিকার তাজুল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২২ মে ২০২৫ ০৮:০১ | আপডেট: ২২ মে ২০২৫ ০৮:১৮

চা বাগান থেকে পাতা সংগ্রহ করে নিলামে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। ছবি: সংগৃহীত

সিলেট: ১৭০ বছরের পুরনো চা শিল্পে সংকট ক্রমশ বেড়েই চলেছে। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ না পাওয়া, ব্যাংক লোনের সুদহার বৃদ্ধি, নিলাম ব্যবস্থার ফাঁদ সিন্ডিকেটসহ না কারণে এই সংকট ঘণীভূত হচ্ছে। এছাড়া, ভারত থেকে চোরাই পথে নিম্ন মানের চা আমদানি বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে। আর বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রায় অর্ধেক দামে চা বিক্রি করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে সিলেট ও চট্টগ্রামের চা শিল্পে অস্থিরতা বিরাজ করছে।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, এ বছর রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য পূরণ নিয়ে রয়েছে নানা সংশয়। বর্তমানে প্রতি কেজি চা পাতা (কাঁচা পাতা) উৎপাদনে বাগান মালিকদের ২৪০ টাকা খরচ হলেও সেটি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত বাগান মালিকরা লোকসানের মুখে পড়ছে। এ অবস্থায় চা বাগান টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। কোনো কোনো বাগান মালিক আবার ব্যবসা গোটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

এদিকে কিছু কিছু বাগান মালিক নিয়মিত শ্রমিকদের বেতনই পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। গত সপ্তাহে সিলেটে শ্রমিকদের বড় একটি বিক্ষোভে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয় এবং তারা সড়ক অবরোধ করে।

সিলেটের কয়েকটি বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, লোকসানের মুখে পড়ায় সরকারের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত নিলামে চায়ের কেজি সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়ে আসছেন। কিন্তু সেটি কার্যকর না হওয়ায় অধিকাংশ বাগান মালিকই অর্থ সংকটে পড়েছেন। ফলে তারা শ্রমিকদের বেতন ভাতা দিতে পারছেন না এবং বাগানে বাগানে শ্রমিক উত্তেজনার পরিবেশও সৃষ্টি হচ্ছে।

তারা জানান, ব্রিটিশ আমলের নিলাম ব্যবস্থার ফাঁদ সিন্ডিকেট, ভারতীয় নিম্নমানের চায়ের আগ্রাসন বাজারে চরমভাবে দেশীয় চা শিল্পকে চাপে ফেলেছে। এছাড়া, ব্যাংক ঋণের অভাব ও সরকারের নীরবতায় সিলেটে একের পর এক চা বাগান বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে। বাজারে দখলদারিত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে। এতে করে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে।

এ নিয়ে সম্প্রতি সিলেটের ১৩টি বাগানের মালিক কর্তৃপক্ষ প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে তারা সিলেটের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন।

সিলেটের তারাপুর চা-বাগানের ম্যানেজার রিঙ্কু চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০২২ সালে কেন্দ্রীয়ভাবে যখন শ্রমিকরা আন্দোলন করল, তখন থেকেই এ শিল্পে ধস নেমে এসেছে। তখন প্রায় এক মাস বাগান বন্ধ ছিল। এর পর ২০২৩ সালে শুরু হয়েছে দরপতন। যে চায়ের উৎপাদন খরচ ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, নিলামে সেই চায়ের দাম নেমে এসেছে ১০০ টাকার নিচে। যেভাবে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে এতে করে অনেক বাগানই বন্ধ হওয়ার উপক্রম। শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন ভাতা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে সরকারের দিক থেকে এখনই উদ্যোগ না নিলে সংকট আরও ঘণীভূত হবে।’

এদিকে বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গত সপ্তাহের বৈঠকে সিলেটের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। বিষয়টি তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবগত করবেন বলেও জানান।

নিলামে চা কেনার পর সেগুলো ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ছবি: সারাবাংলা

নিলামে চা কেনার পর সেগুলো ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ছবি: সারাবাংলা

প্রধান উপদেষ্টার কাছে সিলেটের ১৩ বাগান মালিকের দেওয়া আবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালে চা শিল্প, শ্রমিক আন্দোলনের মুখে যে অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল তা থেকে এখনো বাগান মালিক কর্তৃপক্ষ বের হতে পারেননি। ছোট-বড় প্রায় সব বাগানই বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে ‘ক্রপ লোন’ নিয়ে থাকেন। চায়ের নিলাম মূল্য সরাসরি কৃষি ব্যাংকে জমা হয়ে তা পরিশোধ করা হয়। এই ঋণ পরিশোধের সুদের হার ৯ ভাগ থেকে বর্তমানে ১৪ দশমিক ৫০ ভাগ করা হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় তা পরিশোধ করা বাগানগুলোর পক্ষে অসম্ভব।

বাগান মালিকরা ঋণ পরিশোধের সুদের হার পাঁচ ভাগ রাখার জন্য এবং ঋণ পরিশোধের সময়সীমার ব্যাপারে শিথিলনীতি গ্রহণের জন্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট থেকে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য আবেদন জানান। একইসঙ্গে দেশের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত চা রফতানি করার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার আহ্বান জানান তারা।

চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দাবি হচ্ছে, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্যে অবিলম্বে প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটির মাধ্যমে চা বাগানের সৃষ্ট সমস্যাগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে সমাধান করতে হবে। বিশেষ করে চা বাগানগুলোকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনতে হবে। কৃষিঋণ প্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতাও কমাতে হবে। চা নিলামে বর্তমানে যে সিন্ডিকেট রয়েছে তা ভাঙতে হবে। চা বাগানগুলো যাতে উপযুক্ত দাম পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে চা বাগানের সমস্যা সমাধানে টি বোর্ড, মালিকপক্ষ ও প্রশাসনকে একযোগে কাজ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, ১৮৫৪ সালে ভারতবর্ষের বাংলাদেশ অংশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে। বাংলাদেশ চা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে চা বাগান রয়েছে ১৬৭টি। এর মধ্যে ১৩৮টি সিলেটে। এসব বাগানে এক লাখ ৪০ হাজারের মতো শ্রমিক কাজ করছেন।

সারাবাংলা/পিটিএম

উৎপাদন খরচ ২৪০ চা শিল্প বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা সংকট সিলেট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর