বেলজিয়াম: ৭ মে পালিত হলো বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। ওইদিন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেন বিশ্বের প্রভাবশালী সাংবাদিক, প্রযুক্তিবিদ, মানবাধিকারকর্মী, গবেষক ও জাতিসংঘের কর্মকর্তারা। এবারের সম্মেলনে আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, নারী সাংবাদিকদের অধিকার এবং বৈশ্বিক তথ্য বিভ্রান্তি রোধ।
‘এআই’ সুযোগ না হুমকি?
সম্মেলনে জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি আইরিন খান বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এআই এখন বাস্তবতা, যা থেকে পালানোর উপায় নেই। এটা মেনে নিতে হবে। আমাদের কাজ হলো এটিকে মানবাধিকারের পক্ষে কাজে লাগানো।’ তিনি উল্লেখ করেন, এআই যেমন সাংবাদিকদের কাজে সহায়তা করতে পারে, তেমনি এটি ভুল তথ্য ছড়ানোর হাতিয়ারেও পরিণত হতে পারে। কিন্তু এটিকে যেন মানবিক কল্যাণে কাজে লাগানো হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন রিপোর্ট অফিসের পরিচালক পেদ্রো কনসেইসাও জানান, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ২০ শতাং মানুষ এআই ব্যবহার করছে; এবং নিম্নআয়ের দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ আগামী এক বছরে এআই-কে জীবনের অংশ হিসেবে দেখতে চায়। তিনি জাতিসংঘের সদ্যপ্রকাশিত মানব উন্নয়ন রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘এআই সঠিকভাবে ব্যবহার করলে মানব উন্নয়নে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’
আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ফেডারেশনের সভাপতি ডমিনিক প্রাদালি এআই’কে আখ্যা দেন ‘পয়জনড সিরাপ’ বা ‘বিষমিশ্রিত শরবত’ হিসেবে। তার মতে, ‘এআই-ড্রাইভেন অ্যালগরিদমগুলো মূলত প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থে কাজ করে। ফলে প্রকৃত তথ্যের বদলে বিভ্রান্তিকর, মনোযোগ-বিনিময়যোগ্য কনটেন্ট ছড়ায়।’ তিনি একে ‘গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন। প্রাদালি বলেন, ‘এখন প্ল্যাটফর্মগুলোর অ্যালগরিদমিক সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক লাভকে প্রাধান্য দেয়। ফলে গুরুত্বহীন ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়ে।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এআই-এর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি স্বচ্ছ ও বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক আইনগত কাঠামো প্রয়োজন। সাংবাদিকদের জন্য আজও কোনো বৈশ্বিক আইনি সুরক্ষা কাঠামো নেই। ২০০৬ সালে রুশ সাংবাদিক আনা পলিটকোভস্কায়ার মৃত্যুর পর থেকে দুই হাজারেরও বেশি সাংবাদিক নিহত, ৫০০ জনের বেশি কারাবন্দি এবং অনেকেই নির্বাসনে রয়েছেন। আমি মনে করি সাংবাদিকদের সুরক্ষায় একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন প্রণয়ন করতে হবে।’
ফিলিস্তিন সংকট
সাংবাদিক হত্যা ও যুদ্ধকালীন স্বাধীনতা সম্মেলনে বিশেষভাবে আলোচনা হয় গাজা ও ফিলিস্তিনের চলমান সংঘাত নিয়ে। সম্মেলনে বক্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, সেখানে অসংখ্য সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, যাদের অনেকেই যুদ্ধের সংবাদ কভার করতে গিয়ে প্রাণ হারান। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা সেখানে কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিকে গণমাধ্যমের ওপর সরাসরি আঘাত বলে মন্তব্য করেন অনেকেই।
নারী সাংবাদিকদের অধিকার ও চ্যালেঞ্জ
নারী সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা, হয়রানি এবং পেশাগত বৈষম্যও আলোচনায় স্থান পায়। বক্তারা বলেন, আজকের গণমাধ্যম জগতে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, তারা নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। বিশেষ করে অনলাইন হয়রানি ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা দ্রুত হারে বাড়ছে।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের এই সম্মেলন ছিল সাংবাদিকতা ও প্রযুক্তির যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও দিকনির্দেশনা নিয়ে ভাবার একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। এআই-কে মানবিকভাবে ব্যবহারের আহ্বান, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং যুদ্ধ ও সহিংসতার ভেতর থেকেও সত্যের সন্ধান অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি ছিল এই সম্মেলনের মূল বার্তা।