ঢাকা: আজ আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। প্রতিবছর ২২ মে পালিত হয় এই দিনটি। যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও তা রক্ষায় সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। জীববৈচিত্র্য বলতে বোঝায় পৃথিবীর সব ধরনের জীবের—উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব এবং এদের বাস্তুতন্ত্রে পারস্পরিক সম্পর্কের বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যই আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। জাতিসংঘ ২০০০ সালে এই দিবসটি ঘোষণা করে, যার উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীবজগৎ রক্ষায় বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরি করা।
জীববৈচিত্র্য কী ও কেন গুরুত্বপূর্ণ?
জীববৈচিত্র্য অর্থ হলো পৃথিবীতে বিদ্যমান জীবনের বৈচিত্র্য—উদ্ভিদ, প্রাণী, ছত্রাক এবং অন্যান্য জীবের প্রজাতির সংখ্যা ও পারস্পরিক সম্পর্ক। এই বৈচিত্র্য শুধু বন ও বন্যপ্রাণী নয়, বরং ফসল উৎপাদন, ওষুধ আবিষ্কার, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ ও মানুষের জীবিকা নির্বাহের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য
২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসের থিম হলো “Harmony with Nature and Sustainable Development”, অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেকসই উন্নয়ন। এই থিম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে মানুষের উন্নয়নের পথ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় রেখেই হতে হবে।
প্রাকৃতিক সুরের সিম্ফনি
পাহাড়ে গেয়ে ওঠা পাখির কলতান, নদীর তীরে লাফিয়ে বেড়ানো মাছ, কিংবা বনের ছায়ায় বেড়ে ওঠা নানা রঙের বৃক্ষ—এই সব কিছুই জীববৈচিত্র্যের অংশ। এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভূমিকা রয়েছে পরিবেশে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানি যে মৌমাছি পরাগায়নের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে, আবার উট বা হাতির মতো প্রাণীরা মরু বা বনজ বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ, মধু সংগ্রহকারী মৌমাছি না থাকলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। আবার উদ্ভিদের রুট সিস্টেম না থাকলে ভূমিক্ষয় বেড়ে যাবে। একটিমাত্র প্রজাতি হারানো হয়তো অনেকের কাছে ছোট বিষয় মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতির চক্রে প্রতিটি জীবের ভূমিকা রয়েছে।
সংকটের মুখে প্রাণপ্রবাহ
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ হুমকির মুখে। বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, অতিরিক্ত শিকার ও শিল্পায়নের কারণে অনেক প্রজাতি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে, অনেক আবার বিলুপ্তির পথে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে আমাদের খাদ্য, পানি, ওষুধ এমনকি আবাসনের ওপরও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।অতিরিক্ত কৃষিকাজ ও শিকার—এসব কারণে দ্রুত হারে কমে যাচ্ছে প্রাণী ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্য। দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদণ অনুযায়ী লুক্সেমবার্গের একদল গবেষকদের গবেষণায় উঠে এসেছে, বর্তমানে প্রাকৃতিক হারে প্রজাতি বিলুপ্তির তুলনায় হাজার গুণ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ।বড় বড় প্রজাতি যেমন বাঘ, গণ্ডার, হাতি হারিয়ে যাচ্ছে যেমন, তেমনি অজস্র ছোট প্রজাতির কীটপতঙ্গ, মাছ এবং অণুজীবও হারিয়ে যাচ্ছে নীরবে। অথচ এই ছোট ছোট জীবই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ শুধু বিজ্ঞানীদের কাজ নয়, এটি আমাদের প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। ছোট ছোট অভ্যাসের পরিবর্তন যেমন—প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো, গাছ লাগানো, স্থানীয় প্রজাতিকে সুরক্ষা দেওয়া বা টেকসই পণ্য ব্যবহার—সবই এই দায়িত্ব পালনের অংশ হতে পারে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আমাদের করণীয়
বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য গবেষণা ফোরাম (বিবিআরএফ) ও প্রকৃতি সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা তাদের গবেষণায় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও করণীয় নিয়ে বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
- বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ: বৃক্ষরোপণ ও বন উজাড় বন্ধ করতে হবে।
- প্লাস্টিক ও রাসায়নিক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ: জলাশয় ও ভূমি দূষণ রোধ করা প্রয়োজন।
- টেকসই কৃষি ও মৎস্যচাষ: প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা পদ্ধতিতে উৎপাদন বাড়ানো।
- শিক্ষা ও সচেতনতা: জীববৈচিত্র্য বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়াতে সচেতনতা বৃদ্ধি।
- স্থানীয় প্রজাতির সংরক্ষণ: স্থানীয় ফল, বীজ ও প্রাণী প্রজাতিকে রক্ষা করা।
বাংলাদেশ ও জীববৈচিত্র্য
বাংলাদেশ একটি জীববৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, হাওর ও ম্যানগ্রোভ অঞ্চল—এসব এলাকায় রয়েছে অগণিত প্রাণী ও উদ্ভিদের বসবাস। কিন্তু এসব এলাকাও আজ হুমকির মুখে। তাই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণ প্রকল্প চালানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস শুধুই একটি আনুষ্ঠানিক দিবস নয়; এটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রকৃতি আমাদের জীবনধারণের মৌলিক ভিত্তি। আমরা যদি জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করি, তাহলে নিজেদের ভবিষ্যৎও ধ্বংস করে ফেলব। তাই এই দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক—প্রকৃতির সঙ্গে সুর মিলিয়ে, একটি টেকসই ও সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা।