ঢাকা: রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সরকারি গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটে ছাত্রদের আবাসিক হলে গড়ে উঠেছে ভয়াবহ টর্চার সেল। গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হলে ডেকে এনে প্লাস দিয়ে টেনে নখ তুলে ফেলা এবং গাঁজার আগুনে শরীর ঝলসে দেওয়ার মতো ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এই টর্চার সেলের নেপথ্যে ছাত্রদলের কয়েকজন কর্মী জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
গত ১৫ মে (বৃহস্পতিবার) রাতভর তিন শিক্ষার্থীকে মোবাইল চুরির অভিযোগে নির্যাতন করা হয়। শনিবার (২৪ মে) দুপুরে মোহাম্মদপুর গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা একটি মানববন্ধন করে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, গত ১৫ মে (বৃহস্পতিবার) রাতে ডিজাইন বিভাগের ৫ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফরহাদ হোসেন শাওন ও একই ব্যাচের প্রিন্টিং বিভাগের টিটু হোসেন মোল্লাকে মোবাইল চুরির অভিযোগে ছাত্রাবাসের ৩১৮ নম্বর রুমে আটক করে। পরে ছাত্রদল কর্মী মাহীর ফোন থেকে ডিজাইন বিভাগের ৫ম ব্যাচের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান গাল্টুকে ছাত্রাবাসে ডেকে আনা হয়। এর পর তিনজনকে ৩১৮ নম্বর রুমে আটকে রাত ১২টা থেকে টানা ভোর ৪টা পর্যন্ত নির্যাতন চালায় ৭ম ব্যাচের শিক্ষার্থী মিনারুল, সাব্বির, অংকন ও রকি।
রাতভর মারধর করা শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ছাত্রদল কর্মী হিসেবে পরিচিত বলে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানান। তাদের মারধরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন আরিফুর রহমান গাল্টু। তাকে টানা ১৮ ঘণ্টা নির্যাতন করা হয়। এর পর তার সহপাঠীরা বিষয়টি জানলে তারা গাল্টুর পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি মোবাইল জানায়। পরবর্তী সময়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে স্থানীয় থানা পুলিশের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়।
মারধরের শিকার ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান গাল্টু বলেন, ‘১৫ মে রাতে আমি ডিউটি শেষ করে বাসায় যাওয়ার পর ৭ম ব্যাচের বড় ভাই মহিউদ্দিন মাহী আমাকে ফোন করে ছাত্রাবাসে যেতে বলেন। আমি তখন তাকে বুঝিয়ে বলি, মাত্র ডিউটি থেকে এসেছি। সকালে এসেই আপনার সঙ্গে দেখা করব। কিন্তু তিনি আমাকে ফোন দিয়ে এতটাই চাপ দিচ্ছিলেন যে, আমি ক্যাম্পাসের হলে যেতে বাধ্য হই। সেখানে যাওয়ার পর শুনি একজনের মোবাইল হারিয়ে গেছে, আর সেই মোবাইল নাকি আমি নিয়েছি। এ নিয়ে আমাকে এবং আমার ব্যাচের আরও দু’জনকে আলাদা আলাদা রুমে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে আমি বলি আমি মোবাইলের বিষয়ে জানি না। তখন আমাকে মিনারুল, সাব্বির, অংকন ও রকি প্রচণ্ড মারধর করে।’
তিনি বলেন, ‘রাত ১২টা থেকে ভোর পর্যন্ত টানা কয়েকঘণ্টা লোহার রড, পাইপ ও স্ট্যাম্প দিয়ে পেটায়। আমি মারধরের পর বেশ কয়েকবার অচেতন হয়ে পড়ি। তখন তারা আমাকে আলাদা একটা রুমে তালা মেরে ফেলে রাখে। আমার জ্ঞান ফেরার পর দেখি পরের দিন দুপুর ৩টা বাজে। ওইসময় আমি আমার এক ফ্রেন্ডকে দেখে কোনোরকমে ডাক দিয়ে আমার পরিবারকে বিষয়টি জানাতে বলি। পরে সে আমার বোনকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানানোর পর তিনি পুলিশ নিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমাকে এমনভাবে নির্যাতন করেছে আমি কয়েকদিন ঠিকমতো হাঁটতে পারি না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পিটিয়ে আমাকে জখম করেছে। আমাকে মারতে মারতে তারা বলছিল, আবরার ফাহাদ, তোফাজ্জলের অবস্থা দেখছস? তোর এমন অবস্থা হবে। আমি বারবার তাদের পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েও কোনো লাভ হয়নি।’
মোবাইল চুরির অভিযোগ এনে ফরহাদ হোসেন শাওন ও টিটু মোল্লা নামের আরও দুই শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়। তাদেরও রুমে আটকে গভীর রাত পর্যন্ত বেধরক পেটায় তারা। এ ঘটনার পর শনিবার (১৭ মে) তানভীর নামে আরেক শিক্ষার্থীকে একই গ্রুপের সদস্যরা রুমে আটকে রাতভর নির্মম নির্যাতন করে। নির্যাতনের বর্ননা দিতে গিয়ে তানভীর বলেন, ‘আমাকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে প্লাস দিয়ে নখ টেনে তুলেছে। তারা আমাকে মারতে মারতে গাঁজা খেয়ে সেই আগুন দিয়ে হাতে ছেঁকা দিয়েছে। আমি এখন ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছি না। যারা আমার ওপর এমন ভয়াবহ নির্যাতন করেছে আমি তাদের সর্বোচ্চ বিচার চাই।’
মারধরের শিকার গাল্টুর বোন নিশাত তাসনীম বলেন, ‘আমার ভাইকে সারারাত ফোনে পাচ্ছিলাম না। পরদিন দুপুরের পর ভাইয়ের নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে কল আসে। আমি কোনো উপায় না পেয়ে ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে পুলিশের সহায়তায় ছাত্রাবাসে যাই। পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পর তারা আমার ভাইকে লুকিয়ে ফেলে। পরে পুলিশ প্রেশার দিলে তারা ভাইকে বের করে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। এর পর থানায় অভিযোগ দায়ের করি। বিষয়টি কলেজের প্রিন্সিপালকে জানিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। এখন দেখার বিষয় তারা কী ব্যবস্থা নেন।’
ঘটনার বিবরণ দিয়ে গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিটিউটের অধ্যক্ষ ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, ‘ঘটনার পর জড়িতদের সাময়িক বহিষ্কার করেছি। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আমার কাছে আরও দু’দিন সময় চেয়েছে। যেহেতু হলে এমন একটি অমানবিক ঘটনা ঘটেছে, তাই আমরা হল পুরোপুরি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারি। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে স্থায়ী বহিষ্কারসহ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলী ইফতেখার বলেন, ‘এ ঘটনায় একজন মামলা করেছেন। আরও কয়েক শিক্ষার্থী এসেছিলেন। আমরা তাদের অভিযোগ দিতে বলছি। জড়িত সবার বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’