Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নানা সংকটের ফয়সালা হচ্ছে গ্রাম আদালতে


২৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৮:৪৯

মেসবাহ শিমুল, চরকুকরী মুকরী থেকে ফিরে

বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরকুকরী মুকরীর প্রধান বাজারটি তখন ঝিমিয়ে এসেছে। সাপ্তাহিক হাটের দিন  হওয়ায় বাজারের দোকানগুলোয় তখনো দু’য়েকজন লোক চোখে পড়ে। বাজারের পূর্বপাশের ছোটো রাস্তা ধরে সামনে এগোলে ইউনিয়ন পরিষদ ভবন। দ্বীপ এলাকা হওয়ায় ভবনটির অবকাঠামো সাইক্লোন শেল্টারের আদলে করা। দূর থেকে ইউপি ভবনের দোতলার বারান্দায় জনা কয়েক লোকের অবস্থান চোখে পড়লো। সিঁড়ি ভেঙ্গে কাছে গিয়ে দেখলাম একটি কক্ষে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও তার সামনে আরো ক’জন লোক বসে আছেন। জানলাম তারা সাগরে মাছধরা নিয়ে একটি  মামলার শুনানীতে এসেছেন চেয়ারম্যানের দপ্তরে। এখানে গ্রাম আদালতে তাদের বিচার হবে।

বিজ্ঞাপন

চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন। তিনি এই চরের চেয়ারম্যান হলেও পুরো পরিবার থাকে উপজেলা শহর চরফ্যাশনে। জনগণের নানামূখী সেবা দিতে তাকে কোনো কোনো সপ্তাহে সাতদিনই এই পরিষদ ভবনে থাকতে হয়। ওই দিনও দুইটি সালিশ রয়েছে। তারই একটি এই সাগরে মাছ ধরা নিয়ে বিবাদ বিষয়ক মোকদ্দমা। মামলার বাদি পক্ষ পৌঁছেছে, বিবাদীপক্ষ তখনও আসেনি।

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ১৭ নম্বর ওই মামলার বিবাদী বা আসামিপক্ষ এসে হাজির হয় সদলবলে। নিরিবিলি স্থানের এই ইউপি ভবনটি তখন সরগরম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো শুনানি।

মামলার বিবরণে জানা গেল, সাগরে মাছ ধরা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। উভয়পক্ষই মারধর করেছে। তবে যিনি বেশি মার খেয়েছেন তিনিই বাদি হয়ে মামলা ঠুকেছেন গ্রাম আদালতে। আর এখন উভয় পক্ষের বিশ্বাস চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় গ্রাম আদালতেই একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। মিলেমিশে যাবে আবার এই বিবদমান দুই পক্ষ। আবার একসঙ্গে সাগরে মাছ ধরবেন কিংবা মিলেমিশে থাকবেন লোকালয়ে।

বিজ্ঞাপন

গ্রাম আদালতের কাঠামোয় ইউপি চেয়ারম্যানই হাকিম। ইউপি’র দুই জন সদস্য থাকেন প্রতিনিধি হিসেবে। আর বাদি ও বিবাদি পক্ষের প্রতিনিধি হয়ে আসেন দুই জন। তারা প্যানেল বিচারক। এই পাঁচ জনের দায়িত্ব বিচারকাজ চালানো। সঙ্গে সরকার কিংবা প্রকল্পের নিয়োগপ্রাপ্ত একজন আদালত সহকারী থাকেন।

এই আদালতের সহকারীর নাম লাইজু বেগম। তিনি সারাবাংলাকে জানালেন, ছোট-বড় অনেক বিবাদই এই আদালতে মিমাংসা হয়ে যায়। গ্রামবাসী এই আদালতের ওপর আস্থা রাখে বলেই এখানে বিচার চাইতে আসে।

ততক্ষণে দুই জেলের মারামারি মামলার নিষ্পত্তি করে ফেলেছেন আদালতের হাকিম ও প্যানেল বিচারকরা। দুই পক্ষ কোলাকুলি করে মিলেও গেলো।

গ্রাম আদালতে মামলা পরিচালনায় কোন উকিল থাকে না। বাদি-বিবাদি নিজেরাই নিজেদের কথা বলেন এবং দ্রুত সমাধান হয়ে যায়।

গ্রাম আদালত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প। গ্রামাঞ্চলের ছোট ছোট দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিরোধ স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় এ আদালত গঠনে ১৯৭৬ সালে একটি অধ্যাদেশ প্রণীত হয়। যা পরবর্তীতে ২০০৬ সালের ০৯ মে কার্যকর হয়।

কুকরীমুকরী গ্রাম আদালতের সহকারী লাইজু বেগম জানালেন, দ্বিতীয় মেয়াদে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রাম আদালতের কাজ শুরু হয়েছে এই চরে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০টি মামলা এসেছে এই আদালতে। যার প্রায় সবগুলোরই নিস্পত্তি হয়েছে। বাকি দুয়েকটি যা রয়েছে সেগুলোরও নিস্পত্তি হবে।

মামলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে লাইজু বেগম জানালেন, এ আদালতে মামলা করতে চাইলে দেওয়ানী মামলার জন্য ২০ টাকা এবং ফৌজদারি মামলার জন্য ১০ টাকা ফি দিতে হয়। অফিস চলাকালে যে কেউ এসে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে পারেন। প্যানেলের নূন্যতম চারজন যে রায় দিবেন সে রায় উভয় পক্ষকে মেনে নিতে হয়।

কোনো রায়ে বাদি বা আসামি পক্ষ সন্তুষ্ট না হলে লিখিতভাবে আপিল করতে পারেন। আপিলেও ফয়সালা না হলে জুডিসিয়াল কোর্টে যাওয়ারও এখতিয়ার রয়েছে এ আইনে।

মাঠ পর্যায়ে  গ্রাম আদালত সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সরকারের পক্ষ থেকে রয়েছে নির্দেশনা।

প্রতি মাসে ৯টি উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে এ আদালত সম্পর্কে জানানো হয় গ্রামবাসীদের। পারিবারিক কলহ থেকে শুরু করে ফৌজদারি অপরাধ যাতে এড়ানো যায় প্রথমে সে বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয় তাদের। কোনো কারণে যদি মামলার প্রয়োজন হয় তবে জুডিসিয়াল কোর্টে না গিয়ে যাতে গ্রাম আদালতের শরণাপন্ন হয় সে বিষয়েও বোঝানো হয় গ্রামবাসীদের। এতে করে সময় এবং খরচ বাঁচানোর পাশাপাশি সহজ ফয়সালা পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন লাইজু বেগম।

মামলা সম্পর্কে চেয়ারম্যান হাশেম মহাজন বললেন, জমিজমা নিয়ে একটি মামলার নিস্পত্তি করেছি বিকেলে। ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে ফয়সালা হয়েছে। উভয় পক্ষ সন্তুষ্ট। তারা মিষ্টিমূখ করে এখান থেকে গেছে।

তিনি বলেন, এই চরে খুব বেশি মামলা হয় না। মানুষ এমনিতেই শান্তিপ্রিয়। কাজকর্ম নিয়ে থাকে। সাগরে মাছ ধরা নিয়ে কোন্দল আর বাল্য বিয়ে সংক্রান্ত মামলাই এখানে বেশি আসে। এই চরের কেউ মামলার জন্য জুডিসিয়াল কোর্টে যায় না। মূলত যেসব সমস্যা তা গ্রাম আদালতের মাধ্যমেই আমরা সমাধান করে দেই।

পরিষদ ভবন থেকে বের হতে রাত প্রায় সাড়ে ৮টা বেজে গেলো। চরকুকরী মুকরী বাজারের মধ্যভাগের একটি চায়ের দোকানে কথা হয় স্থানীয়দের সঙ্গে। সেখানে গ্রাম আদালত প্রসঙ্গ তুলতেই দোকানদার হাবিবুর রহমান বললেন, গত শুক্রবার তিনি একটি মামলায় বাদি পক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন। পারিবারিক মামলা। সুন্দর নিস্পত্তি হয়েছে। ছেলেপক্ষ মেয়েকে ঘরে নিয়ে গেছে। এখন আর কোনো ঝামেলা নেই।

দোকানি হাবিবুরের মতে, এসব ছোটোখাটো বিষয়ই মামলা-মোকদ্দামা করে বড় করা হয়। এর নিষ্পত্তি খুব সহজ। সমস্যা আসলে খুববেশি নয়। গ্রাম আদালত সে বিষয়টিই প্রমাণ করছে।

সারাবাংলা/এমইউ/এমএম

 

 

ইউনিয়ন পরিষদ গ্রাম আদালত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর