রংপুর: আর মাত্র ১২ দিন বাকি পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানি ঈদের। আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে রংপুর বিভাগের আট জেলায় চাহিদার তুলনায় বেশি কোরবানির পশু প্রস্তুত করেছেন খামারি ও গৃহস্থরা। চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি থাকায় এই ঈদকে সামনে রেখে অনেক খামারি ও গৃহস্থরা পশু বিক্রির মধ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত আয়ের স্বপ্ন দেখলেও শঙ্কা আছে ভারতীয় গরু প্রবেশ নিয়ে। তবে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ গরু চোরাচালান রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর।
এদিকে বিগত সময়গুলোতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা সরাসরি হাট থেকে পশু সংগ্রহ করলেও এবারের চিত্র ভিন্ন। পাইকাররা খামারমুখি হওয়ায় অন্যান্য বছরের তুলনায় হাটে গরু আসছে কম, তাই ভোক্তা পর্যায়ে দামও বেশি হবে এবার এমনটাই শঙ্কা করছেন ক্রেতারা।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার পবিত্র ঈদুল আজহায় বিভাগের আট জেলায় ১৪ লাখ ১২ হাজারের বেশি কোরবানির পশুর চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বিভাগের এক লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ ছোট-বড় খামারির মাধ্যমে ১৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৯০টি গরু, মহিষ, ছাগল, উট, দুম্বা ও ভেড়াসহ কোরবানির পশু প্রস্তুত করেছেন খামারি ও গৃহস্থরা। যা এই বিভাগের মোট চাহিদার চেয়ে প্রায় ৫ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি। এর মধ্যে উট এবং দুম্বাও রয়েছে শতাধিক।
জানা গেছে, এ বছর রংপুর বিভাগের আট জেলায় স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে ২৯৫টি হাট বসবে। শেষ সময়ে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা পশুর পরিচর্যা করছেন খামারি ও গৃহস্থরা। অনেকে আবার খামার থেকে গরু বিক্রি শুরু করেছেন। কেউবা অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে কোরবানির পশু কেনাবেচার পথ বেছে নিয়েছেন।
রংপুরে গেল কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশু চাহিদা যোগানের চেয়ে বেশি হয়। অতিরিক্ত এসব পশুর মূল ক্রেতা ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটসহ বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ক্রেতারা। তবে বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন হাটে বেশি হাসিল আদায়, দালালের দৌরাত্ম্যের কারণে এবার সেই পাইকারি পশু ক্রেতাদেরই দেখা মিলছে না হাটগুলোতে। দালালের কারণে সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যেও দেখা গেছে হাটবিমুখতা। অনেকে পশু কিনছেন সরাসরি খামার থেকে। এতে কোরবানি ঈদের দুই সপ্তাহ আগেও জমেনি জেলার বেশির ভাগ হাট।
রংপুরের বেশ কয়েকটি হাটের ইজারাদার জানান, বিগত বছরগুলোতে কোরবানি ঈদের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার হাটে ২৫ লাখের বেশি গরু বিক্রি হতো। এই গরুর ৮০ ভাগ ক্রেতাই থাকত উত্তরাঞ্চলের বাইরে বৃহত্তর ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। তবে এবার তাদের দেখা নেই তেমন।
পাইকাররা বলছেন, হাসিলের নামে হাট ইজারাদারের লোকজনের বেশি টাকা আদায় ও দালালদের উৎপাতের কারণে অনেক পাইকার আগ্রহ হারিয়েছেন। এ বছর হাসিলের বিষয়টি শুরু না হলেও দালালদের অসহনীয় উৎপাত রয়েছে। সেইসঙ্গে পরিবহণ খরচও অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া, বিক্রেতারা আগে কিনতে আসায় ক্রেতাদের দামে ছাড় দিতেও রাজি হচ্ছেন না। সবমিলিয়ে বাইরের পাইকার কমেছে।
গত কয়েকদিন ধরে সরেজমিন নগরীর লালবাগ, গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ী হাট এবং পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা গরুর হাট ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। এসব হাটে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য বছরের তুলনায় গরু এসেছে কম, কিছু দাম বেশি। অন্যবার বাইরের পাইকারদের পাশাপাশি স্থানীয় ক্রেতার ভিড় দেখা গেলেও এবার তেমন ভিড় নেই। তবে ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে বিক্রি তত বাড়বে বলে আশা ব্যবসায়ীদের।
চতরা হাটে গরু নিয়ে আসা মোসলেম উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্রেতারা শুধু দাম জিজ্ঞেস করে, কিন্তু নেয় না। দামও বলেন না।’ তবে তিনি জানান, এবারে ছোট গরুর চাহিদা অনেক বেশি। লালবাগ হাটে আসা রওনক হাসান ও টিপু সুলতান জানান, বাজেট অনুযায়ী হাটে তেমন গরু নেই। গরুর দাম যাচাই করতে এসে ঘুরে যান তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গরুর হাটগুলোতে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছোট গরুর। ৭০ থেকে ৯০ হাজারের মধ্যে যেসব গরু আছে সেসবের চাহিদা বেশি। বিশেষ করে মাংসের মণ (৪০ কেজি) হিসেব করে দাম নির্ধারণ করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু গেল বছরে মাঝারি সাইজের গরুর চাহিদা বেশি থাকলেও এবার সেটা ছোট গরুতে নেমে এসেছে।
এদিকে হাটগুলোতে স্থানীয় ক্রেতাও কমে এসেছে। ঝামেলা এড়াতে অনেকেই খামারে পশু অর্ডার দিচ্ছেন। অনেকে আবার হাটে নিয়ে আসার আগে সড়ক থেকেই পশু কেনার চেষ্টা করছেন। নগরির সাতমাথা, মাহিগঞ্জ এলাকায় পশুর খামার আছে এমন সংখ্যা অনেক। ওই এলাকার খামারি তোহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা আসছেন। তবে তারা গরুর দাম কম বলছেন। এখনও বেচাকেনা সেভাবে শুরু হয়নি।’
নগরীর দমদমায় এলাকার খামারি রফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতবার ছয়টি গরু লালন-পালন করে ঈদের সময় দুটো বিক্রি করতে পারিনি। এজন্য এবার ঝুঁকি না নিয়ে তিনটি গরু লালন-পালন করেছি। ন্যায্য দাম পেলে আমি এবার সব গরু বিক্রি করে দেব। পাইকারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকে গরু দেখে যাচ্ছেন, কিন্তু ক্রেতা যে দাম বলছেন সেটা খুব কম। গরুর লালন-পালন করতে অনেক খরচ হয়েছে।’
আশরাফুল আলম নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, গরু কেনার জন্য হাটে যাওয়ার সাহস করতে পারছেন না। দালাল বাদে হাটে গরু কেনার সুযোগ নেই। নিজেরা দরদাম করে গরু কেনার চেষ্টা করলেও দালালদের সিণ্ডিকেট আটকে দেয়। ক্রেতা-বিক্রেতাকে হুমকি, অপমান অপদস্ত করে। হাটের মধ্যে মাঝে মাঝে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে যায়। নানা কায়দায় দালালরা টাকা আদায় করে। তিনি বলেন, ‘হাটে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ার চেয়ে এবার দামে কিছুটা বেশি দিয়ে হলেও খামার থেকে গরু কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এদিকে দেশি গরুতেই কোরবানির জোগান সম্ভব হবে বলে মনে করছেন খামারিরা। এ জন্য চোরাচালান ঠেকাতে নজরদারি বাড়ানোর দাবি তাদের। খামারি ও প্রান্তিক পর্যায়ের গৃহস্থরা বলছেন, ভারতীয় গরু দেশে প্রবেশ না করলে কোরবানির হাটে ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাবে। ডেইরি ফার্মাস অ্যাসোসিয়েশনের রংপুর বিভাগের সভাপতি লতিফুর রহমান মিলন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসন্ন ঈদুল আজহা ঘিরে কোরবানির জন্য রংপুর বিভাগে পর্যাপ্ত গরু ও ছাগল রয়েছে। এ কারণে বাইরে থেকে গরু-ছাগল আমদানি করতে হবে না। বরং এই অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত পশু দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা সম্ভব হবে। তাই সীমান্ত দিয়ে গরু চোরাচালান বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ ভারতীয় গরু ঢুকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের খামারিরা।’
সীমান্ত দিয়ে অবৈধ গরু চোরাচালান রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে রংপুর প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. আব্দুল হাই সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘গরু চোরাচালান রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এবার পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ থেকেই গবাদিপশু আসবে না। ফলে খামারিরা গরুর ভালো দাম পাবেন।’