ঢাকা: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে কোনো রকম দ্বিমত নেই।
সোমবার (২৬ মে) জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এক সংবাদ ব্রিফিং এ কথা বলেন তিনি।
আলী রিয়াজ বলেন, ‘বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্নে এখন ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। এর মধ্যে বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতবার নির্বাচিত হতে পারবেন, একজন সংসদ সদস্য কতগুলো পদে থাকতে পারবেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী হবে, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া কী হবে এই ধরনের মৌলিক কাঠামোগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অমীমাংসিত থেকে গেছে।’
তবে এইসব বিষয়ে অনেক দলই আরও আলোচনার কথা বলেছেন এবং আলোচনায় নমনীয়তা দেখিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে আলী রিয়াজ বলেন, ‘বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকারের। রাজনৈতিক দলগুলো নির্ধারণ করবে প্রক্রিয়াটা কী হবে।’
তিনি বলেন, ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কিছু দল অবশ্য এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন।’
তিনি আরও জানান, নিম্নকক্ষে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণের প্রশ্নে এক ধরনের ঐকমত্য রয়েছে দলগুলোর মধ্যে। তবে এর পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘যারা সংসদের উভয় কক্ষের পক্ষে এবং যারা এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে উভয়ই পক্ষই ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়ার পক্ষে। আর উচ্চকক্ষ গঠনকে সে সব দল সমর্থন করে তারা ১০০ জন সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠনের ব্যাপারে একমত। তবে এই প্রতিনিধিদের কীভাবে নির্বাচন করা হবে সংবিধান সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারের সুপারিশে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকলেও এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।’
সংবিধানে রাষ্ট্রপতির অনুচ্ছেদ নিয়ে তিনি বলেন, ‘৪৮ (ক) অনুচ্ছেদ যা কার্যত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নির্ধারণ করে, তা সংশোধনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে হবে সেই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।’
আলী রিয়াজ বলেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদ, অর্থাৎ সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেবার ক্ষেত্রে যে বিধান তা পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্য হলেও, কী কী বিষয়ে দলের পক্ষে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক হবে তার একটি আংশিক তালিকার ব্যপারে ঐকমত্য হয়েছে। অর্থ বিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন বিলের ব্যাপারে দলীয় অনুশাসনের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে অধিকাংশ দল একমত, এর অতিরিক্ত আরও কিছু যুক্ত করার, যেমন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবিষয়ক বিল যুক্ত করার জন্যেও কিছু দলের প্রস্তাব আছে।’
তিনি বলেন, ‘আইনসভার গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতিত্ব পদবিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের দেওয়ার ব্যাপারে প্রায় সকলেই একমত।’
সংস্কারের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে খুব শিগগিরই দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু করতে পরিকল্পনা করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। এ ক্ষেত্রে মে মাসের শেষে বা জুনের শুরুতে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় এই পর্বে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি বা দলগুলোর অবস্থান কাছাকাছি সেসব বিষয় আলোচিত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ ছাড়া কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, বিচারপতি এমদাদুল হক, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, সরকার ২০২৪ সালের অক্টোবরে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনগুলো ২০২৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করে।
পরবর্তীতে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা তার নেতৃত্বে এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানদের নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেন। কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ শুরু করে। এই কমিশনের দায়িত্ব হলো রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৫টি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে তাদের মতামত দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়। ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত সুপারিশ ছিল ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সুপারিশ ছিল ২০টি।
স্পেডশিটে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়। প্রথমটি হলো, সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কিনা। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়। সেগুলো হলো একমত, একমত নই ও আংশিকভাবে একমত। এ তিনটি বিকল্পের যেকোনো একটিতে টিকচিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছিল। এ ছাড়া সুপারিশগুলোর ব্যাপারে মন্তব্য দেওয়ার একটি জায়গাও রাখা হয়েছিল।
স্প্রেডশিট পাঠানোর পর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ১৫ মার্চের মধ্যে মতামত জমা দেওয়ার অনুরোধ জানায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কিন্তু কিছু রাজনৈতিক স্প্রেডশিটে মতামত দেওয়ার জন্য সময় বাড়ানোর অনুরোধ জানায়। পরবর্তীতে মোট ৩৫টি রাজনৈতিক দল/জোটের কাছ থেকে মতামত পাওয়া যায়। কিছু কিছু দল স্প্রেডশিটে মতামত দেওয়ার পাশাপাশি কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে উল্লেখিত সুপারিশের ব্যাপারে বিস্তারিত মন্তব্য ও বিশ্লেষণ জমা দেয়।
দলগুলোর মতামত পাওয়ার পাশাপাশি গত ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে’র মধ্যে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার সুবিধার্থে কয়েকটি দলের সঙ্গে একাধিক দিনও বৈঠক চলে।