Wednesday 28 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাইবার নিরাপত্তা মামলা
‎১২ বছর ধরে হাজিরা দিচ্ছেন সাংবাদিক আহমেদ আতিক

উজ্জল জিসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৬ মে ২০২৫ ২২:২২ | আপডেট: ২৬ মে ২০২৫ ২২:২৪

সাংবাদিক আহমেদ আতিক। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরা। রাতের আঁধারে ভারতীয় সৈন্য ঢুকে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের বাড়ি ঘরে হামলা চালিয়েছে- এমন খবর প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকায়। তখন নড়েচড়ে বসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওইদিন বিকেলে মিডিয়া পাড়ায় গুঞ্জন ওঠে খবরের রিপোর্টার আহমেদ আতিককে গ্রেফতার করা হতে পারে। আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হলো সন্ধ্যার পর। ইনকিলাব অফিসে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) অভিযান চালিয়ে কূটনৈতিক বিটের রিপোর্টার আহমেদ আতিকসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে।

বিজ্ঞাপন

আহমেদ আতিকের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ডিএমপির ওয়ারী থানায় মামলা দেওয়া হয়। মামলা নম্বর-১১(১),২০১৪। ধারা দেওয়া হয়, ২০০৬, (সংশোধিত ২০১৩) ধারা ৫৭ (১), (২), ৬৬ (১), (২)। এর পর হাজত খেটে জামিনে বের হন তিনি। সেই থেকে আহমেদ আতিক প্রায় ১২ বছর ধরে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ১০৯ বার হাজিরা দিয়েছেন তিনি। সরকারের পর সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু আহমেদ আতিকের মামলা শেষ হয়নি। মোট ছয়বার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হলেও গত ১২ বছরে মামলার চার্জশিট পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে আহমেদ আতিকের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘আদালতে যেতে যেতে বিরক্ত হয়েছি, অর্থ নষ্ট করেছি, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ১২ বছর একটি মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়েছে- এমন লোকের সংখ্যা হয়তো খুঁজে পাবেন হাতে গোনা কয়েকজন। ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। এর পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার হয়রানিমুলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য বলা হয়েছে। এমনকি সাইবার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলও হয়েছে। কিন্তু আমার মামলাটি রয়েই গেছে। সামনেও হাজিরা দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন জমার কথা বলা হলে আইন মন্ত্রণালয়, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ডিএমপি ও বিএনপি উইংয়ে আবেদন করি। এরপরেও আমার মামলাটি প্রত্যাহার হচ্ছে না। কোথায় আটকে আছে সেটিও বুঝতে পারছি না। আদালতে জিজ্ঞেস করা হলে বলেন, আমরা কোনো কাগজ পাইনি। তাই সামনের তারিখেও হাজিরা দিতে হবে।’

এই মামলার ৬ নম্বর তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) গণি ইয়ামিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি নতুন করে এই মামলার তদন্তভার পেয়েছি। মামলাটি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে মামলার চার্জশিট বা ফাইনাল রিপোর্ট যা হয় তা শিগগিরই দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আহমেদ আতিকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ আহমেদ গাজী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এতবছর একটি মামলা চলতে পারে নাকি? তদন্ত প্রতিবেদন দেবে, হয় পক্ষে যাবে না, হয় বিপক্ষে যাবে। বিচারে যা হয় হবে। কিন্তু সেটি হয়নি দীর্ঘদিনেও। নতুন আইন অনুযায়ী নতুন করে আর সাইবার আইনে মামলা হবে না, তবে আগের মামলা চলবে। আবার মামলা প্রত্যাহারের কথা বলা হলেও আমরা আবেদন করেছি। কিন্তু সেটিরও কোনো কাগজ আদালতে আসেনি। একজন বিচার প্রার্থী আর কতদিন অপেক্ষা করতে পারে?’

২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি যা ঘটেছিল ইনকিলাব অফিসে

‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকার সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, পত্রিকার প্রকাশক, প্রধান বার্তা সম্পাদক ও এক প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। রাজধানীর আর কে মিশন রোডে ওই পত্রিকার কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে পাঁচজনকে নিয়ে যায় পুলিশ। তারা হলেন- পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদক রবিউল্লাহ রবি, উপ-বার্তা সম্পাদক রফিক মোহাম্মদ, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আফজাল বারী, কূটনৈতিক প্রতিবেদক আহমেদ আতিক ও বার্তা সম্পাদনা বিভাগের কম্পিউটার অপারেটর শহীদুল ইসলাম। পর দিন তাদের আদালতে তোলা হয়।

‘ইনকিলাব’র বিশেষ সংবাদদাতা শাখাওয়াত হোসেন বাদশা ওই সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পুলিশ ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে গিয়ে অবস্থান নিয়ে কম্পিউটারে তল্লাশি চালায়। এরপর আহমেদ আতিককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এছাড়া, তল্লাশি শেষে ‘ইনকিলাব’র ছাপাখানায় তালা লাগিয়ে দেয় পুলিশ।

ওয়ারী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলম ওই সময় জানান, পত্রিকা ও ওয়েবসাইটে মিথ্যে সংবাদ প্রচারের অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে পুলিশ বাদী হয়ে ওয়ারী থানায় মামলা করেছে। মামলায় এসআই অভিযোগ করেন, আজ ‘ইনকিলাব’ পত্রিকায় ‘সাতক্ষীরায় যৌথবাহিনীর অভিযানে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা’ শিরোনামে একটি খবর ছাপা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমতিসাপেক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিল্লির কাছে চিঠি দিয়ে ওই সহায়তা চেয়েছে। এতে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের অনুমতি নিয়ে পুলিশ ‘ইনকিলাব’ পত্রিকার কার্যালয়ে তল্লাশি চালায়।

ইনকিলাবের ওই দিনের সেই প্রতিবেদনটি পাওয়া না গেলেও সামহোয়্যারইন ব্লগে ওই দিনের একটি লেখা পাওয়া যায়। ‘সরকারী বার্তা ফাঁস: সাতক্ষীরায় অভিযানে ভারতীয় বাহিনী! সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড়’ শিরোনামে ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি দুপুর ১২টা ৫১ মিনিটে সামহোয়্যারইন ব্লগে একটি লেখা প্রকাশ হয়। সেখানে নিউজটা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গত ২১ মে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এ নাগরিক সুরক্ষার প্রয়োজনীয় বিধান ছিল না। ফলে সেই আইন অপব্যবহার ও নিপীড়নের সুযোগ তৈরি করেছিল এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছিল। তাই ওই আইন বাতিল করে সাইবার সুরক্ষা নিশ্চিত করা, অনলাইনে সংঘটিত অপরাধ শনাক্ত, প্রতিরোধ, দমন ও এসব অপরাধের বিচারসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জন্য নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।

এর আগে, গত ৬ মে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশটির খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। এ অধ্যাদেশে সাইবার নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশে ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, নিষিদ্ধ করা হয়েছে অনলাইন জুয়া। এছাড়া, অনলাইনে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং যৌন হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

অধ্যাদেশে আগের আইনের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি, কুৎসামূলক প্রচারণার দণ্ড, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচার সংক্রান্ত ধারাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, এর অপরাধ ও দণ্ড, আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শন, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ-প্রকাশ ইত্যাদি ধারাও বিলুপ্ত করা হয়েছে।

আগের আইনের কিছু কিছু ধারায় পরিবর্তন এনে অধ্যাদেশে রাখা হয়েছে। ধর্মীয় বা জাতিগত বিষয়ে সহিংসতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক তথ্য প্রকাশ ইত্যাদির অপরাধ ও দণ্ডের বিষয়টি পরিবর্তন এনে রাখা হয়েছে। মত প্রকাশের মামলা জামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে যদি সাইবার অপরাধ করা হয় সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

১২ বছর আহমেদ আতিক সাইবার মামলা সাংবাদিক হাজিরা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর