Thursday 29 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফাঁসির মঞ্চ থেকে যেভাবে রাজনীতির মাঠে এটিএম আজহার

রাশেদ মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৮ মে ২০২৫ ২৩:০৩

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম। ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান হঠাৎ-ই পালটে দিল সবকিছু। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালালেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলো। ক্ষমতার ভার গিয়ে উঠল নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে। তার পর থেকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটাতে শুরু করল দেশের আইন ও শাসন ব্যবস্থার চিত্রও। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া থেকে শুরু করে দলটির বড় বড় নেতাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ আমলে করা মামলাগুলো বাতিল হলো। পাশাপাশি কিছু মামলা থেকে খালাসও পেলেন তারা। অন্যান্য দলের নেতাদের ক্ষেত্রেও তাই হলো।

বিজ্ঞাপন

তবে, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সুরাহা যেন হচ্ছিলই না। অবশেষে গত ২৭ মে তার বিরুদ্ধে করা মামলা থেকে খালাসের রায় দিলেন আদালত। এর মধ্য দিয়ে কনডেম সেলের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে মুক্ত পরিবেশে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে কনডেমে সেলে যিনি দীর্ঘ দিন পার করেছেন, ফাঁসির দড়ি গলায় পরানোর অপেক্ষায় ছিলেন যিনি, যার জীবন গুনছিলেন মৃত্যুর প্রহর- সেই জামায়াত নেতার গলায় উঠল ফুলের মালা। এলেন রাজনৈতিক অঙ্গনে। প্রায় ১৩ বছরের বন্দিজীবনের অবসানের পর এটিএম আজহারুল ইসলামকে বরণ করে নিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা।

বিজ্ঞাপন

আজহারের কারামুক্তির দিন তথা বুধবার সকাল থেকেই রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে আসতে থাকেন জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা। পিকআপভ্যানে গড়ে তোলা হয় অস্থায়ী মঞ্চ। আর পাশেই বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা পিজি হাসপাতালের বিভিন্ন ফটকে অপেক্ষা করতে থাকেন কেউ কেউ। শীর্ষ নেতাদের মুখেও ছিল হাসি। এর মধ্যেই সকাল ৮টা ৩৮ মিনিটে হাসপাতালে আসেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।

এর পর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ওঠেন পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেল তথা ডি-ব্লকের দোতলায়। সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন এটিএম আজহার। বর্তমান আমিরকে পেয়ে বুকে টেনে নেন তিনি। এবার মুক্ত বাতাসের স্বাদ নেওয়ার প্রস্তুতি। কেবিনের বাইরে পুলিশ আর কারারক্ষীরাও যেন ছুটির অপেক্ষায়। ঘড়ির কাঁটায় ৯টা ১৫। ধীরে ধীরে নিজেদের ব্যাগপত্র নিয়ে হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে বেরোতে থাকেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সেসব সদস্য। এর মিনিট দশেক পরই সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে বেরিয়ে আসেন জামায়াতের এই সাবেক নেতা।

হাসপাতালের ফটকের সামনে মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন নেতাকর্মীদের সঙ্গে। এর পরই জামায়াত আমিরের গাড়ি বহরে শাহবাগের সেই মঞ্চে আসেন। দেওয়া হয় সংবর্ধনা। বক্তব্য দেন তিনি। তুলে ধরেন বন্দিশালার কিছু স্মৃতি। ২০১৯ সালে ফাঁসির হুকুম পেয়ে প্রস্তুতি নিয়ে রাখার কথাও জানান।

এটিএম আজহার বলেন, ‘আদালত যখন ফাঁসির হুকুম দিলেন তখন থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। ফাঁসির মঞ্চে উঠে আল্লাহর কাছে হাজির হবো। আর এটাই আমার জন্য সহজ পথ। কোনো ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। আমার কাছে যার যে আমানত ছিল দিয়েও দিয়েছিলাম।’

দলের নেতাকর্মীদের ত্যাগের কথাও অকপটে তুলে ধরেন। কৃতজ্ঞতা জানান জুলাই যোদ্ধাদের প্রতি। তিনি বলেন, ‘৩৬ জুলাইয়ের মহাবিপ্লবী নায়কদের জন্য আমি মুক্তি পেয়েছি। তাদের অক্লান্ত আন্দোলন ও পরিশ্রমের মাধ্যমে স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন সম্ভব হয়েছিল। একই সঙ্গে আদালতকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এতদিন ন্যায়বিচার ছিল না।’

২৭ মে সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে এটিএম আজহারকে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস দেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সর্বসম্মতিক্রমে এ রায় ঘোষণা করা হয়। এই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পেয়েছেন।

এটিএম আজহারুল ইসলামকে খালাস দিয়ে চারটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রথমত, এ মামলার অতীতের রায়ে বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার পদ্ধতি বদলে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্যপ্রমাণ মূল্যায়ন করা ছাড়াই এটিএম আজহারকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। তৃতীয়ত, পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে বিচারের নামে অবিচার করা হয়েছিল। এছাড়া, যেসব তথ্যপ্রমাণ আদালতে হাজির করা হয়েছিল, অতীতের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দেন আপিল বিভাগ।

রিভিউ বোর্ড গঠন করে অতীতের সব রায় পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন আজহারের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অতীতের অনেকে আদেশ সম্পর্কে এ রায়ে অনেক পর্যবেক্ষণ থাকবে। এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর একটি রিভিউ বোর্ড গঠন করে অতীতের সব রায় পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। যেন মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে হলেও যাদের সঙ্গে অন্যায়-অবিচার করা হয়েছে, তাদের পরিবার কিংবা এ দেশের মানুষ ন্যায়বিচার পেতে পারে।

এটিএম আজহারুল ইসলামকে গ্রেফতার ও তার বিরুদ্ধে রায়

২০১২ সালের ২২ অগাস্ট মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেফতার হন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম। তখন থেকেই তিনি কারাগারে ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীল মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির পর ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর এ টি এম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। পরবর্তীতে আপিল বিভাগের রায় রিভিউ চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আবেদন করেন এটিএম আজহার। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে ফের সামনে আসে আজহারের মামলার আপিল শুনানি।

আজহারের আপিল শুনানির প্রথম দিন

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে করা আপিলের রায় শুরু হয় গেল ৬ মে। এদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আসামিপক্ষে শুনানি করেন শিশির মনির। ৯০ শতাংশের শুনানিতে সাক্ষীদের কিছু বয়ান তুলে ধরেন আদালতের কাছে।

রাষ্ট্রপক্ষের এমনই এক সাক্ষী ছিলেন, যিনি নিজের স্ত্রী-সন্তানের সংখ্যা বলতে পারেননি। এমনকি বিয়ে করেছিলেন কবে সেটিও মনে ছিল না। একজন সাক্ষী ইংরেজি ১২ মাসের নাম বলতে না পারলেও ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এটিএম আজহারুলকে কোথায় কীভাবে দেখছেন সেটা ঠিকই বলতে পেরেছেন। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের ঘটনায়ও আজহারকে দেখতে পান আরেক সাক্ষী। এসব সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করেই এটিএম আজহারুল ইসলামের দণ্ড দেওয়া হয়।

প্রকাশিত তিন পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত আদেশের কিছু তুলে ধরা হলো

এ মামলায় দাখিলকৃত সবধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্মূল্যায়ন করেছেন আপিল বিভাগ। এতে আপিলকারীর দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কারণ ছিল ফৌজদারি আইনের মৌলিক নীতির প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞা। এছাড়া আগের রায়ে তার বিরুদ্ধে প্রমাণের ত্রুটি ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের বিস্তৃত প্রেক্ষাপটের প্রতি যথাযথ বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি ফৌজদারি কার্যধারায় বাধ্যতামূলক যাচাই-বাছাই ও ন্যায্যতার উচ্চমান পূরণে ব্যর্থ হয়েছে পূর্বের আপিল বিভাগ।

এ মামলায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট ও প্রসিকিউশন টিমের অন্তর্নিহিত প্রমাণের প্রতি যথাযথ বিবেচনা করা হয়নি। তাই আপিল বিভাগ দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করছে যে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপিলকারীর দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজা বহাল রাখা সম্ভব নয়।

জামায়াতের এই নেতাকে ফের রাজনীতির মাঠে দেখতে চান নেতাকর্মীরা। তারা জানান, এটিএম আজহার একজন মজলুম। তার মুক্তিতে সবাই খুশি। তিনি ফের দলের হাল ধরবেন বলে আশা করছেন অনেকেই। তবে আপাতত কিছুদিন তিনি বিশ্রামে থাকবেন বলে জানিয়েছেন জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। এরপর স্বাভাবিকভাবেই সবধরনের কার্যক্রমে অংশ নেবেন।

সারাবাংলা/আরএম/পিটিএম

এটিএম আজহারুল ইসলাম জামায়াত নেতা ফাঁসির মঞ্চ রাজনীতির মাঠ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর