পৃথিবীতে যত মনীষীর জন্ম হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই নিজের কর্ম, চিন্তা ও দর্শনের দ্বারা নিজ নিজ জনপদে বিশেষ পরিচিতি বা অমরত্ব লাভ করেছেন। এদের কেউ কেউ নিজস্ব চিন্তা, দর্শন ও কর্মের দ্বারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বের বুকে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন। বাংলাদেশের ক্ষণজন্মা পুরুষ শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার রহমান নিজস্ব কাজ, চিন্তা ও দর্শনের দ্বারা বাঙালি জাতির হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। যেমন- বৃক্ষ রোপন, খাল খনন কর্মসূচি, বিদেশে শ্রমবাজার, মুক্তবাজার অর্থনীতি, পোশাক রফতানি ইত্যাদি। তবে, তার যে দু’টি কাজ সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, তা হলো খাল খনন এবং ১৯ দফা কর্মসূচি।
রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন জিয়াউর রহমান। তার এই কর্মসূচিকে বিএনপি তো বটেই জাতীয়তাবাদের দর্শনের বিশ্বাসী এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জাতির মুক্তির সনদ মনে করে। অনেকেই বলে থাকেন বিএনপি বা যেকোনো রাজনৈতিক দল যদি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে, তাহলে জাতীয় জীবনের বেশিরভাগ সমস্য সমাধান হওয়া সম্ভব। যদিও ক্ষমতায় গেলে কেউ-ই আর জিয়িউর রহমানের ১৯ দফা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে না।
জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা
১. সর্বোতভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।
২. শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা।
৩. সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে একটি আত্বনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা।
৪. প্রশাসনের সর্বস্তরে, উন্নয়ন কার্যক্রম এবং আইন-শৃংখলা রক্ষার ব্যাপারে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৫. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা।
৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ করা এবং কেউ যেন ভুখা না থাকে তার ব্যবস্থা করা।
৭. দেশে কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সকলের জন্য অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করা।
৮. কোন নাগরিক গৃহহীন না থাকে তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা।
৯. দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।
১০. সকল দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।
১১. সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতষ্ঠা করা এবং যুব সমাজকে সুসঙ্গহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা।
১২. দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারী খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান।
১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।
১৪. সরকারি চাকুরীজীবিদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তিতে উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা।
১৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করা।
১৬. সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলির সাথে সম্পর্ক জোরদার করা।
১৭. প্রশাসন এবং উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকাররে শক্তিশালী করা।
১৮. দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা।
১৯. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুদৃঢ় করা।
এই ১৯ দফা কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ছিল উন্নয়নের হার বাড়ানো, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরনির্ভরশীলতা কমানো, আয়ের সুষম বণ্টন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এজন্য ১৯৮০ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জিয়াউর রহমানের ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেন। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও রফতানি আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামের জনগণকে সম্পৃক্ত করে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত করা ছিল পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য। বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের অগ্রণী ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে তার ১৯ দফার অনেকগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সর্বোতভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। তার জীবদ্দশায় বহিঃশত্রুর আক্রমণ নিয়ে ভাবতে হয়নি বাংলাদেশকে। নিজের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রেখে প্রতিবেশিসহ সারা পৃথিবীর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজা রেখেছেন জিয়াউর রহমান।
শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলনে মোটামুটি সফল হয়েছিলেন তিনি। তার গৃহীত নীতি দেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রহণ করেছিল। তার আমলেই রাষ্ট্রীয় সংবিধানে আল্লাহ’র প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা সংযোজিত হয়। তার পরবর্তী যেসব সরকার এসেছে, তারা কেউ রাষ্ট্রীয় সংবিধান থেকে এটি বাদ দিতে পারেনি।
সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে একটি আত্বনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলার কাজটি অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠা, অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি— নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের ভিত তৈরি করেছিলেন তিনি। তার অনুসৃত নীতি ও পদ্ধতি পরবর্তী সরকারগুলোও গ্রহণ করেছিল।
জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় তার ১৯ দফার অনেকগুলো দফা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর তার দল বিএনপি বেশ কয়েকবার ক্ষমতায় এসে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে তার অনুসৃত নীতি অনুসরণ করার। কিছু কিছু জায়গায় সফলও হয়েছে। কিন্তু, দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়-নীতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের ক্ষেত্রে জিয়ার পথে হাঁটতে সেভাবে। তার মূল্যও দিতে হয়েছে দলটিকে। তবে, ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকে নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ স্বপ্ন দেখছে— এবার হয়ত ভালো কিছু হবে। সেক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচিই হতে পারে বিএনপির গাইড লাইন।