সেনাবাহিনীতে জিয়াউর রহমান ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। এ কারণে অনেক উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। বিপদের সমূহ সম্ভাবনা জেনেও জিয়েউর রহমান চট্টগ্রামের সেনাকর্মকর্তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব থামানোর জন্য ১৯৮১ সালের ২৯ মে চট্টগ্রামে যান এবং সেখানে সার্কিট হাউজে থাকেন। ৩০ মে গভীর রাতে সার্কিট হাউজে বিপথগামী একদল সেনাসদস্য তাকে হত্যা করে।
জিয়াউর রহমানের আকস্মিক এই হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. কামাল হোসেনকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। এ সময় তিনি বিএনপির সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন।
এরপর বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের পীড়াপীড়িতে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ক্ষমতাচ্যুত আব্দুস সাত্তার বিএনপির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় প্রথমবারের মতো বক্তৃতা দেন। পরবর্তী সময় বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপাসন হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের চেয়ারপাসন নির্বাচনে হন খালেদা জিয়া। তার নেতৃত্বেই মূলত বিএনপির পূর্ণ বিকাশ হয়।
আকস্মিক হত্যাকাণ্ডের শিকার জিয়াউর রহমান কোনো রাজনৈতিক উত্তরাধিকার মনোনীত করে যেতে পারেননি। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে জিয়াউর রহমান যখন নিহত হন, তখন তার দুই শিশু সন্তান রাজনীতির হাল ধরার উপযুক্ত ছিলেন না। সহধর্মিণী খালেদা জিয়াও ছিলেন আপাদমস্তক গৃহিণী। কিন্তু, পরিস্থিতি এবং দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে রাজনীতির মাঠে আসা খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানের অভাব বুঝতে দেননি দলকে। তার নেতৃত্বে বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থায়ী অবস্থান তৈরি করে নেয়।
বিএনপির দায়িত্ব নিয়েই এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়েন খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ সালে তার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই সময় এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দুর্বাল আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত যুগপৎ আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাধার সৃষ্টি হয়। ১৫ দল ভেঙে ৮ দল ও ৫ দল হয়। ৮ দল নির্বাচনে যায়। এরপর বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল, পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট আন্দোলন চালায় এবং নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ এক দফার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এর ফলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হয়। অবশেষে দীর্ঘ ৯ বছর অবিরাম, নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিএনপি এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া মোট পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন।
জিয়াউর রহমানের পতাকা হাতে নিয়ে বিএনপির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য রূপে দলে যোগ দেওবার পর থেকে মোট ছয় বার তিনি গ্রেফতার হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনার আমলে দুদকের মালায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। এর পর থেকে কার্যত বিএনপির দায়িত্ব বর্তায় জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে তারেক রহমানের ওপর। তার নেতৃত্বে গত সাত বছর বিএনপির রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের দুর্বার গণআন্দোলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর খালেদা জিয়াও অসুস্থ শরীরে দলীয় কর্মসূচিতে মাঝে-মধ্যে ভার্চুয়ালি যুক্ত হচ্ছেন। তবে, খালেদা জিয়ার রাজনীতি ফেরার সম্ভবনা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ আগামী দিনে বিএনপির রাজনীতি জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে তারেক রহমানকে ঘিরেই আবর্তিত হবে। জিয়াউর রহমান থেকে আব্দুস সাত্তার, আব্দুস সাত্তার থেকে খালেদা জিয়া, খালেদা জিয়া থেকে তারেক রহমান— এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি।