ঢাকা: প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে এবারের বাজেটে মানুষকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে- বলে দাবি করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
সোমবার (০২ জুন) টেলিভিশনে প্রদত্ত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট বক্তৃতায় তিনি এমন দাবি করেন।
তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবে আত্মোৎসর্গকারীরা আমাদের সামনে একটি বিরল সুযোগ তৈরি করে দিয়ে গেছেন দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করে ভবিষ্যতের জন্য শক্ত ভিত গড়ার। আপনাদের সকলের সর্বাত্মক সহযোগিতায় সে লক্ষ্য পূরণের প্রত্যয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অঙ্গীকার পূরণ করাই হবে আগামী দিনে আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানোর পরিবর্তে সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণার ওপর জোর এবং অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে অধিকতর মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এ শক্তিশালী ভিতই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান। আগামীর সেই বাংলাদেশে সবার জন্য মানসম্মত জীবন এবং সকল স্তরে বৈষম্যহীন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে আমি সকলের সহযোগিতা চাই।
তিনি বলেন, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, জীবিকার নিরাপত্তা ও বৈষম্যহীন পরিবেশ—এ অত্যাবশ্যক উপাদানগুলো ছাড়া যে কোন রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে, দুর্বল হয় সমাজের ভিত। এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত যে সকল সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার সুবিধা ভোগ এবং যে সকল চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে, তা মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দেয়া হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে একটি উন্নত সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে আমরা যে সকল কার্যক্রম গ্রহণ করেছি, এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে- শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বনভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ- যার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন হবে এ দেশের মানুষের জীবনমানের এবং মুক্তি মিলবে বৈষম্যের দুষ্টচক্র থেকে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি বলেন, ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমাদের উপর বর্তায় বিগত সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং নৈরাজ্য দূর করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কঠিন কাজটি। আমি স্বস্তি এবং আনন্দের সাথে জানাতে চাই, মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সে লক্ষ্য পূরণে অনেকদূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ভেঙে পড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, শ্রমিক অসন্তোষ প্রশমিত করে শিল্প খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং বিগত সরকারের সময়ে লাগামহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফলে চরম সংকটাপন্ন ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের মত কঠিন চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। শুরু থেকেই আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে চেষ্টা করেছি এসব সমস্যার সমাধানপূর্বক দেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। প্রবাস আয়ের আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি, রপ্তানি আয়ের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন অব্যাহত থাকা এবং সঠিক মুদ্রা ও রাজস্বনীতির সমন্বিত প্রয়োগের সুফল হিসেবে আমরা ইতোমধ্যে কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা অর্জনে অনেকদূর এগিয়েছি।
তিনি বলেন, বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্স থেকে এবং দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে শ্বেতপত্র কমিটি থেকে ইতোমধ্যে সুপারিশ পাওয়া গেছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং পরবর্তী অধ্যায়ে বিবৃত খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ সকল সুপারিশসমূহ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, মাত্র অল্প কয়েক মাসে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে স্থিতিশীল করার কাজটি প্রায় সম্পন্ন করে আনা সম্ভব হলেও পরিপূর্ণ সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছুতে আমাদের এখনও অনেকটা পথ পেরোতে হবে। পরিপূর্ণ স্থিতিশীলতা অর্জন করে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনার পথে এখনো বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে।
তিনি বলেন, গত এপ্রিলে মার্কিন প্রশাসন কর্তৃক আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব আমাদের অর্থনীতির উপর পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, সম্প্রতি যে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করা হয়েছে, তার কোন নেতিবাচক প্রভাব আপাতত বাজারের উপর পড়ার সম্ভাবনা না থাকলেও, এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে। এ সকল ঝুঁকি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করা এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও তা এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তবে মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।
তিনি জানান, আমদানির তুলনায় রফতানিতে অধিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ক্রমাগত উন্নতি সাধিত হচ্ছে। ২০২৫ সালের মার্চ মাসের শেষে চলতি হিসাবের ঘাটতি হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ০.৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। তবে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতি চলমান থাকায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়েছে এবং এর ফলে প্রকল্পগুলোর জন্য প্রতিশ্রুত বৈদেশিক ঋণ ছাড়ে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে।
মধ্যমেয়াদে অর্থনীতির গতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর ওপার গুরুত্বারোপ করে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, তুলনীয় অনেক দেশের চাইতে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম। রাজস্ব খাতকে আরও গতিশীল করতে এবং রাজস্ব আহরণে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে ইতোমধ্যে আমরা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। অটোমেটেড ব্যবস্থার মাধ্যমে আয়কর রিটার্ন দাখিল সহজ করা হয়েছে, কর আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন নতুন কর অফিস স্থাপন করা হচ্ছে এবং কর আহরণের মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি রাজস্ব কৌশল তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া, কর ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকর এবং কর আদায়ের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে রাজস্ব নীতি হতে পৃথক করার লক্ষ্যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে স্বাভাবিক নিয়মে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে আনুষ্ঠানিক উত্তরণের। উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনাসমূহ চিহ্নিত করে ইতোমধ্যে স্মোথ ট্রানজিশন পলিসি (এসটিএস)
প্রণয়ন করা হয়েছে। বাণিজ্যিক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লজিস্টিকস্ খাতের উন্নয়নসহ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং বাণিজ্য সম্ভাবনাময় বিভিন্ন দেশ ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোটের সাথে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে।