ঢাকা: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ থাকলেও কিছু কিছু উদ্যোগের কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণ প্রতিকূলভাবে প্রভাবিত হতে পারে বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)।
সংগঠনটি বলেছে, এই বাজেট বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে।
সোমবার (২ জুন) অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সংগঠনটির পাঠানো এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ তথ্য জানানো হয়।
ফিকি বলেছে, ‘বাজেটে যদিও আমরা কিছু ইতিবাচক দিক চিহ্নিত করেছি, তবুও কয়েকটি বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে, যা ব্যবসায়িক সম্প্রসারণকে প্রতিকূলভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং অনুগত করদাতাদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করতে পারে।’
সংগঠনটি বলেছে, ‘ইতিবাচক দিক হিসেবে, অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫ নির্দিষ্ট খাতের উপর চাপ কমানো এবং আরও নির্ভরযোগ্য কর ব্যবস্থা তৈরির প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে। নির্মাণ কোম্পানি এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের উপর উৎস কর হ্রাস করা একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ, যা গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোর জন্য স্বস্তি প্রদান করবে। এছাড়া, যৌথ উদ্যোগ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশের উপর উৎস কর আরোপ না করা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী কোম্পানিসমূহের জন্য একটি সুসংবাদ, যা জেভি পর্যায়ে ইতোমধ্যে কর আরোপিত লাভের উপর দ্বৈত কর প্রতিরোধ করে। আমরা আন্তর্জাতিক কর ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে দ্বৈতকর পরিহার চুক্তিকে আয়কর আইন ২০২৩-এর উপর প্রাধান্য দেওয়ার উদ্যোগ সাধুবাদ জানাই।’
সংগঠনটি জানায়, অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫-এর বেশ কিছু বিতর্কিত বিষয়ও রয়েছে। পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানিগুলোর জন্য, যাদের শেয়ারের ১০ শতাংশ এর কম আইপিওর মাধ্যমে ইস্যু করা হয়েছে, তাদের জন্য অতিরিক্ত ৭.৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব উদ্বেগজনক। বর্ধিত হারে এই করের প্রভাব বৈষম্যমূলক বলে মনে হয়। এছাড়া, ব্যাংকিং মাধ্যমে লেনদেন নিশ্চিত করার জন্য যে হ্রাসকৃত করহার লাভ করার যে সুবিধা ছিল তাও বাদ দেয়া হয়েছে। এরফলে, করের হার ২৭.৫ শতাংশ-এ উন্নীত করার প্রস্তাব আনুষ্ঠানিক অর্থনীতি গড়ে তোলার জাতীয় প্রচেষ্টার বিপরীত এবং ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেবে। আরেকটি, হতাশাজনক দিক হলো বেতনভোগী করদাতাদের উপর প্রভাব। যদিও, প্রাথমিক স্তরে করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে, কিন্তু, সামগ্রীক পরিবর্তন বিবেচনায় প্রবর্তিত পরিবর্তন মধ্য আয়ের করদাতাদের উপরে অতিরিক্ত করের বোঝা সৃষ্টি করবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের জন্য নতুন ৭.৫ শতাংশ অগ্রিম কর (এটি) প্রবর্তন—স্থানীয় মূল্য সংযোজন ৫০ শতাংশ এর নিচে হলে আর কোনো ভ্যাট প্রদানের প্রয়োজন নেই— যা কিনা বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের জন্য ভ্যাট প্রদান সহজ করবে কিন্তু এটি খরচ বাড়াতে পারে যদি মূল্য সংযোজন কম হয়। কর রেয়াত ও ফেরতের সময়সীমা চার মাস থেকে ছয় মাসে বাড়ানোর ফলে চলতি মূলধন সংকটে থাকা ব্যবসায়ীদের জন্য উপকার হবে। অনলাইন বিক্রয়ের উপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা দেশের অনলাইন ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানসমূহকে হুমকির মুখে ফেলবে এবং ব্যবসা সম্প্রসারণে বাধা সৃষ্টি করবে। ইআরএফ সিস্টেমের মাধ্যমে বিক্রয় ও ক্রয়ের রেকর্ড ডিজিটালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা, হার্ড কপি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই, ডিজিটাইজেশনের দিকে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এটি কাগজপত্রের ব্যবহার হ্রাস করে, দক্ষতা বাড়াতে এবং তথ্য সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে সহজতর করবে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কাস্টমস আইন, ২০২৩ আরও আধুনিক ও কার্যকর করতে কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে। শুল্ক কাঠামো বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা এবং শুল্ক পুনর্গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্য করা হয়েছে। পণ্য শ্রেণীবিভাগ সহজতর করতে অসংখ্য এইচএস কোড সংশোধন, একত্রীকরণ বা নতুনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। পণ্য ট্র্যাকিং উন্নত করার জন্য নতুন এইচএস কোড চালু করা হয়েছে, যা বাণিজ্য ব্যবস্থাপনাকে আরও দক্ষ ও স্বচ্ছ করবে। আমদানি নিয়ন্ত্রন সম্পর্কিত বিধি লঙ্ঘন ও কার্গো ঘোষণায় ত্রুটির জরিমানা কমানো হয়েছে, যা আমদানি প্রক্রিয়া সহজ করবে।
ফিকি আরও বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ৭ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালন ও অন্যান্য খাতে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি এবং উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাবিত হয়েছে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা জিডিপির ৯ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬ শতাংশ) নির্বাহের জন্য অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সামাজিক কর্মসূচির জন্য উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যেমন প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি, স্বাস্থ্যে ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি এবং কৃষি খাতে ৩৯ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বিনিয়োগ প্রকল্প উৎসাহিত করার জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ তহবিলে ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে যা বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।