ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলছেন, অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) আছে, সুতরাং ওই সরকারের সংশ্লিষ্ট নেতারাও মুক্তিযোদ্ধা।
শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতাসহ মুজিবনগর সরকারের নেতাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি বাতিলের খবরটি ‘সঠিক নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বরং মুক্তিযোদ্ধাদের আরও বেশি সম্মানিত করা হয়েছে।
বুধবার (৪ জুন) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা সঠিক নয়। সঠিক নয় এই অর্থে যে এখানে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার)। মুজিবনগর সরকার লেখা আছে, তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন, মনসুর আলী সাহেব ছিলেন, কামারুজ্জামান সাহেব ছিলেন, খন্দকার মোশতাক সাহেব ছিলেন, এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা।”
মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা দিয়ে তিন বছর আগের করা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধন করে মঙ্গলবার রাতে অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার।
সেখানে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তনের পাশাপাশি আগে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন, তাদের একটি অংশকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ বলা হয়েছে।
তাতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতাসহ মুজিবনগর সরকারের এমএনএ বা এমপিএদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি আর থাকল না বলে খবর প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
বুধবার সকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, “এই যুদ্ধটা এই সরকার (মুজিবনগর) পরিচালনা করেছে। এই সরকারের লেজিটিমেসির বাইরে কাউকে স্বীকৃতিই দেওয়া হয় নাই। এই সরকারটাই তখন ছিল বাংলাদেশে স্বীকৃত সরকার, যেটা প্রবাসী সরকার।”
উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলছেন, অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) আছে, সুতরাং ওই সরকারের সংশ্লিষ্ট নেতারাও মুক্তিযোদ্ধা।
অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর সংজ্ঞায় যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি, তাদের পাঁচ ক্যাটাগরি করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে বা প্রবাসে অবস্থান করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনের প্রেক্ষাপটে যেসব বাংলাদেশের নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছেন।”
যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত এবং ওই সরকারের নিয়োগ করা চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন; মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ বা এমপিএ; যারা পরে গণপরিষদের সদস্য গণ্য হয়েছিলেন; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়–তাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ বলা হয়েছে অধ্যাদেশে।
একজন সাংবাদিক জানতে চান, এই সংজ্ঞার অর্থ এরকম কি না যে যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা?
জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “এইটা হয় নাই, কারণ রণাঙ্গনটা ওরা পরিচালনা করেছেন। তাহলে তো একই কথা আপনি সেক্টর কমান্ডারদের ব্যাপারেও বলতে পারেন। তারা কি যুদ্ধ করে নাই? যুদ্ধ ডিজাইন করেছে, যুদ্ধে কারা যাবে, না যাবে সেটা পরিচালনা করেছে।
“ঠিক একই রকমের, মুজিবনগর সরকার তো পুরা যুদ্ধটা পরিচালনা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রেশন কোথা থেকে আসবে, অস্ত্র কোথা থেকে আসবে, এগুলি সব এই সরকার করছে না? ফলে এইটা তো ঐতিহাসিক সত্য যে এই সরকার পুরা যুদ্ধটা পরিচালনা করেছে। তো এটা কেমন করে ইতিহাস পরিবর্তন করা যায়?”
তিনি বলেন, “এটা একটা মিসলিডিং নিউজ। আমার মনে হচ্ছে যেন এটা সত্য হয় নাই। এখানে (অধ্যাদেশে) সুস্পষ্ট ভাবেই বলা আছে।”
মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী অংশে মুজিবনগর সরকারের যে বিষয় আছে, সেটা কেন– তা জানতে চান একজন সাংবাদিক।
এ সময় উপদেষ্টা বলেন, “ওইটা মুজিবনগরের কর্মচারীরা। ওইখানে মুজিবনগর সরকারের অধীনে যে সমস্ত বেতনধারী কর্মচারীরা ছিল, তাদেরকে বলা হয়েছে ‘সহযোগী’। সরকারকে বলা হয়নি। আর এমপিএ, এমএনএদের মধ্যেও যারা সশস্ত্রভাবে এসে যুদ্ধ করেছে, তারাও মুক্তিযোদ্ধা।”
মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগীদের মর্যাদায় কোনো হেরফের করা হয়নি বলেও মন্তব্য করেন ফারুক ই আজম, যিনি নিজেও একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি বলেন, “সর্বাঙ্গীণভাবে এইটাকে মর্যাদাশীল করা হয়েছে। এইটা এই নয় যে যারা সহযোগী হবেন, তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। এইটা মোটেও না। কারণ ওই অবদানেও অসাধারণ এবং সেইভাবেই উনাদেরকে সম্মানিত করা হচ্ছে, যে কে কী ধরনের ভূমিকাতে সেই সময় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
“এক্ষেত্রে সুবিধাদি, রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত ভাতা ইত্যাদি নানা সুবিধার ক্ষেত্রেও কোনো বৈষম্য নেই, সবাই সমান।”
‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে আলাদা করার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “যারা যুদ্ধ করেনি তারা কী করে (মুক্তিযোদ্ধা) হইতে পারে? যারা মুক্তিযুদ্ধের কারণে ভারতে গেছে, নানা রকমের কাজে তারা এনগেজ ছিল সেখানে হয়ত, কেউ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, তারপরে কূটনৈতিক এবং অন্যান্য কাজে তারা ব্যস্ত ছিল, তারা সহযোগিতা করেছে, তারা তো রণাঙ্গনে এসে লড়াই করে নাই।”
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম দাবি করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির কারণেই এই সময়ে এসে সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে এ সরকার নতুন করে কোনো সংজ্ঞা প্রবর্তন করেনি।
“বাহাত্তরেও এমন সংজ্ঞা ছিল। এটা পরিবর্তন করা হয়েছে ২০১৮ সলে ও ২০২২ সালে। এখন বাহাত্তরের সংজ্ঞাটা দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় রাখা। দেশের মানুষ জানে মুক্তিযুদ্ধ করা করেছে। মুক্তিযুদ্ধটা যেন বিতর্কিত না হয় সে সেচষ্টা করছি আমরা।”