Friday 06 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চট্টগ্রামের গরুর বাজার
শেষ মুহূর্তের ‘লাভের আশায়’ ক্রেতা-বিক্রেতারা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৪ জুন ২০২৫ ২২:৩২

চট্টগ্রামের সাগরিকা গরুর বাজার। ছবি সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের স্থানীয় কোরবানিদাতারা সাধারণত গরু কেনেন একেবারে শেষ মুহূর্তে। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটছে না এবারও। ঈদুল আজহার তিনদিন আগে এসে চট্টগ্রামের কোরবানির হাটগুলোতে ক্রেতার সমাগম বেড়েছে। তবে ক্রেতা বাজারে ঢুকলেও বিক্রি এখনো কম। গরুর দর যাচাইয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন অধিকাংশ ক্রেতা।

অন্যদিকে বিক্রেতারাও দাম ছাড়ছেন না। এক দর, এক দাম- অনড় বিক্রেতারা। ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, আসলে উভয়ই অপেক্ষায় আছেন ঈদুল আজহার আগের শেষ দু’দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারের জন্য। শনিবার (৭ জুন) পবিত্র ঈদুল আজহা।

বিক্রেতার আশা, সরকারি ছুটি শুরুর পর শেষ দুইদিনে বাজারে ক্রেতার রীতিমতো ঢল নামবে। চাহিদা থাকায় শেষ মুহূর্তে বেশি দরদাম যাচাইয়ে যাবেন না ক্রেতারা। এ জন্য আজকের দিনটা (বুধবার) কোনোমতে দর ধরে রাখতে পারলে, শেষ দু’দিনে বিক্রেতা তার হাঁকানো দামেই বেচতে পারবেন গরু, এমনটাই ভাবছেন তারা। আর ক্রেতার আশা, শেষ মুহূর্তে গরুর দর পড়ে যাবে, ‘পানির দরে’ কিনে বাড়ি ফিরতে পারবেন। তবে অনেকে বাসাবাড়িতে গরু রাখার ঝামেলা এড়াতে শেষ মুহূর্তে কেনেন।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম নগরীর সবচেয়ে বড় কোরবানির হাট সাগরিকা গরুর বাজার। ইজারাদারের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২৯ মে থেকে কোরবানির হাট শুরুর পর গত এক সপ্তাহে এ বাজারে দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে গরু এসেছে প্রায় ১৫ হাজারের মতো। আর বিক্রি হয়েছে প্রায় দুই হাজার। শেষ দুইদিনে আরও অন্তত ৮-১০ হাজার গরু বিক্রি হবে, এমনটাই আশা ইজারাদারের।

বুধবার (৪ জুন) দুপুরে সাগরিকা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতা সমাগমে জমে উঠতে শুরু করেছে এ বাজার। বিক্রেতারা জানালেন, হাটের শুরুর দিন থেকেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়। চার-পাঁচদিন ধরে টানা বৃষ্টির কারণে হাট বলতে গেলে ক্রেতাশূন্যই ছিল। তবে মঙ্গলবার থেকে ক্রেতা আনাগোণা শুরু হয়েছে, বুধবার সেটা আরও বেড়েছে। কিন্তু, ক্রেতারা দরদাম যাচাইয়ে সময় পার করছেন।

সাগরিকা বাজারে দলবেঁধে ঘুরছেন নগরীর বাকলিয়া থেকে যাওয়া মোস্তাক আহমেদ, সেকান্দর আলমসহ কয়েকজন। লাল গরু, সাদা গরু, বড়-ছোট কিংবা মাঝারি- দাম দেখেই যাচ্ছেন।

মোস্তাক আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার দাম অন্যান্যবারের চেয়ে বেশি। বিক্রেতারা গরু ছাড়ছে না। বাজার আরও দু’দিন আছে। তারা হয়তো মনে করছে, শেষ দুইদিনে তাদের দামে গরু বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু এবার কোরবানিদাতার চেয়ে বাজারে গরু বেশি। অ্যাগ্রোতে অনেক গরু। বেপারীদের যে গরু নিয়ে ফেরত যেতে হবে, সেটা বুঝতে পারছে না। আমরা আপাতত দাম দেখছি। বাজারে দেখছি, খামারে দেখছি, দরকার হলে গ্রামের দিকে বাজারে চলে যাব।’

চট্টগ্রামের সাগরিকা গরুর বাজার। ছবি সারাবাংলা

চট্টগ্রামের সাগরিকা গরুর বাজার। ছবি সারাবাংলা

সেকান্দর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল মইজ্জ্যারটেক গেছি, আজ সাগরিকা আসলাম। আমাদের টাকা যার কিসমতে রেখেছেন আল্লাহ, আর যার গরু আমাদের নসিবে রেখেছেন, তার কাছ থেকেই তো কিনব। আপাতত আমরা দেখছি। গরুর দাম একেবারে আহামরি খুব বেশিও না, আবার কেউ একেবারে সস্তায় দিচ্ছেন তা-ও না। দেশের পরিস্থিতি যেরকম, বাজারও সেরকম।’

কুষ্টিয়া থেকে ২২টি গরু নিয়ে এক সপ্তাহ আগে এসেছেন মো. হালিম। বিক্রি করেছেন মাত্র দু’টি। তিনিও বললেন, চট্টগ্রামে যে পরিমাণ গরু উৎপাদন হচ্ছে, তাতে বাইরের জেলা থেকে গরুর আর প্রয়োজন তেমন হচ্ছে না। হালিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘২২টা গরু এনেছি। এক সপ্তায় দুইটা বিক্রি করেছি। কাস্টমার কম। অন্যান্য বছরে ঈদের তিনদিন আগে অর্ধেক গরু বিক্রি হয়ে যেত। এবার বৃষ্টি হয়েছে, তখন বাজারে কাস্টমার একেবারেই ছিল না। আসলে চট্টগ্রামে বাইরের গরু এখন আর লাগে না। অ্যাগ্রোতে যে গরু আছে, সেগুলো দিয়েই কোরবানি হয়ে যায়। সামনে থেকে চট্টগ্রামে গরু আনব কি না, ভাবতে হবে।’

তবে কুমিল্লার চান্দিনা থেকে ৫০টি গরু নিয়ে আসা আলমগীরের ‘ভাগ্য ভালো’। এক সপ্তাহে তিনি ৩০টি গরুই বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছেন। দুই-তিন লাখ টাকার মধ্যে ছোট গরু নিয়ে আসায় বিক্রি করতে পেরেছেন জানিয়ে আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘গরুর দাম এবার একটু বেশি। মনে করেন, গতবারের চেয়ে একটা গরুতে ২০-৩০ হাজার টাকা বেশি। এবার ছোট গরুর দিকে কাস্টমারের ঝোঁক বেশি দেখা যাচ্ছে। বড় গরু কেউ কেউ কিনছে, কিন্তু বেশিরভাগ দরদাম করছে শুধু। এবার মানুষের মধ্যে মনে হয় টাকাপয়সার সমস্যা আছে। আগে যারা একক কোরবানি দিতেন, এবার হয়তো ভাগে দেবেন। আগে যারা একাই দুই-তিনটা দিতেন, এবার হয়তো একটা দেবেন।’

তবে বেপারীদের অনেকের বিক্রি আশানুরূপ নয়। তাদের প্রায় সবাই চেয়ে আছেন শেষ দুই দিনের বাজার পরিস্থিতির দিকে।

সিরাজগঞ্জ থেকে গত রোববার (১ জুন) চারটি গরু নিয়ে সাগরিকা বাজারে এসেছেন শহীদুল ইসলাম। দাম ২ লাখ ২০ হাজার থেকে ১০ লাখের মধ্যে। গত চারদিনে একটিও বিক্রি করতে পারেননি। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে এতদিন তো কাস্টমারই ছিল না। আজ (বুধবার) কিছু কাস্টমার আসছে।’

কুমিল্লার চান্দিনা থেকে ২০টি গরু নিয়ে আসা মোহাম্মদ জসীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিনটা বিক্রি করেছি। আমি ১৫ বছর ধরে সাগরিকা বাজারে আসছি। প্রতিবছর শেষসময়ে বিক্রি বেশি হয়। আরও দুইদিন সময় আছে। বিক্রি হয়ে যাবে, ইনশল্লাহ।’

কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে আসা মনির হোসেন জানালেন, তিনি ৩০টি গরু নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে ৭টি বিক্রি করেছেন। যশোরের মো. সোবহান জানান, ১২টি গরুর মধ্যে তিনি তিনটি বিক্রি করেছেন। শেষ দুইদিনে বাকিগুলো বিক্রি হয়ে যাবে বলেও আশাবাদী তিনি।

সাগরিকা বাজারের অন্যতম ইজারাদার শাহরিয়ার জিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাজার দু’য়েক গরু বিক্রি হয়েছে। আমাদের এখানে মাঠে এখনও দশ হাজারের বেশি গরু আছে। অন্যান্য বছরও এই বাজার থেকে কোরবানিতে সাত-আট হাজার গরু বিক্রি হয়েছে। এবার যদি দশ হাজারের মতো বিক্রি হয় তাহলে মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে শুকরিয়া আদায় করব।’

সাগরিকা বাজারের মতোই অবস্থা চট্টগ্রামের আরেক বড় কোরবানির হাট চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণপ্রান্তের প্রবেশমুখ কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জ্যারটেক বাজারের। সেখানেও ক্রেতার ভিড় বেড়েছে, তবে বিক্রি কম বলে জানালেন বেপারীরা। আর ক্রেতাদের অভিযোগ, দাম ছাড়ছেন না তারা।

চট্টগ্রামের সাগরিকা গরুর বাজার। ছবি সারাবাংলা

চট্টগ্রামের সাগরিকা গরুর বাজার। ছবি সারাবাংলা

তবে নগরীর বাইরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় স্থানীয় বাজারগুলোতে কোরবানির পশু বেচাবিক্রির ধুম লেগেছে বলে জানা গেছে। এবার সরকারি ছুটি বেশি হওয়ায় বেশিসংখ্যক কোরবানিদাতা গ্রামেই ঈদ করবেন, এমন ধারণা প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক কিংবা বেপারীদের। এজন্য এবার গ্রামের হাটে বিক্রি আগের চেয়ে বেশি হবে বলে আশা তাদের।

চট্টগ্রামে এবার স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে মোট ২২৮টি কোরবানির হাট বসেছে। এর মধ্যে ৭৫টি স্থায়ী এবং ১৫৩টি অস্থায়ী হাট। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় নগরীতে ১০টি স্থায়ী ও তিনটি অস্থায়ীসহ মোট ১৩টি হাট বসছে। স্থায়ী হাটগুলো হচ্ছে- সাগরিকা পশুর বাজার, বিবিরহাট গরুর হাট ও পোস্তারপাড় ছাগলের বাজার। এছাড়া ২১৫টি হাট বসছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায়।

চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, সম্ভাব্য হিসাবে চট্টগ্রামে এবার ৮ লাখ ৯৬ হাজার ২৬৯টি পশু কোরবানি হবে। চট্টগ্রামে খামারে এবং গৃহপালিত মিলিয়ে এবার মোট পশু আছে ৮ লাখ ৬০ হাজার ৮৮২টি। এর মধ্যে গরু-মহিষ আছে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৮১৩টি। এর মধ্যে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ২৯টি ষাঁড়, ১ লাখ ২১ হাজার ৬৭০টি বলদ, ৪৯ হাজার ১১৪টি গাভী এবং মহিষ ৬৪ হাজার ১৬৩টি। এছাড়া গয়াল আছে ৩৫টি। ছাগল মজুত আছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৭৪টি ও ভেড়া আছে ৫৫ হাজার ৬৯৭টি।

চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় মধ্যে পশু মজুত আছে ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৭০৫টি। এর মধ্যে মীরসরাইয়ে ৫৮ হাজার ৭৮০টি, সীতাকুণ্ডে ৫৬ হাজার ৮৫০টি, সন্দ্বীপে ৮৫ হাজার ২৫০টি, ফটিকছড়িতে ৬৯ হাজার ৪১৯টি, হাটহাজারীতে ৪৪ হাজার ৮৯০টি, রাউজানে ৩৪ হাজার ৩০২টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৫০ হাজার, বোয়ালখালীতে ২৯ হাজার ৭৪২টি, পটিয়ায় ৭০ হাজার ১৮০টি, কর্ণফুলীতে ৩৩ হাজার ৫৩৩টি, আনোয়ারায় ৬৩ হাজার ৪২৮টি, চন্দনাইশে ৪৭ হাজার ৪টি, সাতকানিয়ায় ৪৫ হাজার ৩৭১টি, , লোহাগাড়ায় ৩৮ হাজার ৫৯টি এবং বাঁশখালীতে ৫৯ হাজার ৪০৪টি পশু মজুত আছে।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে পশু মজুত আছে এক লাখ ৯ হাজার ৭৫৭টি। এর মধ্যে নগরীর ডবলমুরিং এলাকায় ৩৭ হাজার ৫০০টি, কোতোয়ালীতে ৩০ হাজার ৬৯৮টি এবং পাঁচলাইশে ৪১ হাজার ৫৫৯টি পশুর মজুত আছে। এছাড়া, আরও প্রায় দুই লাখ পশু বিভিন্ন অস্থায়ী খামার ও গৃহস্থের কাছে আছে বলে তথ্য প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের।

চাহিদার অনুপাতে ঘাটতি থাকা ৩৫ হাজার পশু কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য জেলা থেকে পূরণ হচ্ছে বলে জানান প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

গরুর বাজার চট্টগ্রাম হাট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর