সাতক্ষীরা: শনিবার দেশজুড়ে উদযাপিত হবে পবিত্র ঈদুল আযহা। কোরবানির পশু কেনার শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততায় যখন হাটগুলো সরগরম থাকার কথা, তখন সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র সাতক্ষীরায়। জেলার বড় বড় পশুর হাটগুলোতে ক্রেতা সংকট এতটাই তীব্র যে, খামারি ও বিক্রেতাদের চোখে-মুখে এখন হতাশার ছাপ। গো-খাদ্যের আকাশছোঁয়া দামের বিপরীতে গরুর কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় বিক্রেতারা যেমন দিশেহারা, তেমনি বেচাকেনা না হওয়ায় বড় অংকের লোকসানের কালো মেঘ দেখছেন হাট ইজারাদাররাও।
ঈদের ঠিক আগের দিনেও জেলার সবচেয়ে বড় পশুর হাট ‘আবাদের হাট’ এবং তৃতীয় বৃহত্তম হাট ‘পাটকেলঘাটা’ ছিল অনেকটাই ক্রেতাশূন্য। হাটে যে পরিমাণ গরু আনা হয়েছিল, তার সিংহভাগই অবিক্রিত থেকে গেছে। বিক্রেতারা বলছেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার হাটে আসা গরুর সংখ্যাও কম, কারণ অনেকেই লোকসানের ভয়ে আগে থেকেই সতর্ক।
দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার টানাপোড়েন
সরেজমিনে দেখা যায়, এ বছর গরুর মাংসের দাম মণপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের (৩২-৩৫ হাজার টাকা) তুলনায়ও কম। তবুও ক্রেতাদের সাড়া মিলছে না।
পাটকেলঘাটা হাটে গরু কিনতে আসা মাহতাবউদ্দীন বলেন, “যে গরুর ওজন তিন মণের বেশি হবে না, তার দাম চাওয়া হচ্ছে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। আমার মতে, এই গরুর দাম কোনোভাবেই ৯০ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।”
অন্যদিকে, গরুর ব্যাপারী আরশেদুল ইসলাম হতাশ কণ্ঠে বলেন, “মাঝারি আকারের ১০টি গরু নিয়ে এসেছিলাম। ঈদের আগের সন্ধ্যা পর্যন্ত মাত্র ৪টি বিক্রি করতে পেরেছি। বাকিগুলো অবিক্রিত অবস্থায় বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।”
লোকসানের কারণ: গো-খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও উদ্বৃত্ত পশু
কয়েক বছর আগে ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ায় সাতক্ষীরায় দেশি খামারের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। মাত্র দুই বছরে খামারের সংখ্যা ১০ হাজার থেকে বেড়ে প্রায় ১৩ হাজারে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু খামার বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়েনি গরুর দাম। বরং বিচালি, কুঁড়া ও খৈলের মতো গো-খাদ্যের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় খামারিদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে বহুগুণ।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খামারি আমিনুর রহমান বলেন, “যে হারে খাবারের দাম বেড়েছে, সে হারে মাংসের দাম বাড়েনি। খামারগুলোকে বাঁচাতে হলে সরকারের উচিত গো-খাদ্য ও মাংসের দামের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করা। এভাবে চলতে থাকলে খামারিরা পথে বসে যাবে।”
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জেলায় কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত আছে ১ লক্ষ ৬০৬টি, যেখানে চাহিদা রয়েছে ৮৫ হাজার ৩১৮টির। অর্থাৎ, প্রায় ১৫ হাজার ২৮৮টি পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। এই অতিরিক্ত সরবরাহও দাম না পাওয়ার একটি বড় কারণ।
মাথায় হাত ইজারাদারদের
বেচাকেনা কম হওয়ায় অর্ধকোটি টাকা দিয়ে ‘আবাদের হাট’ ইজারা নেওয়া ফারুক রহমানের মাথায় হাত। তিনি বলেন, “এ বছর হাটে কেনাবেচা নেই বললেই চলে। শুধু ছোট আকারের কিছু গরু বিক্রি হয়েছে। বড় গরুর কোনো ক্রেতাই পাওয়া যায়নি। আমাদের বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে।”
এদিকে, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. বিষ্ণুপদ বিশ্বাস জানিয়েছেন, পশুর হাটে রোগাক্রান্ত ও অসুস্থ পশু বিক্রি ঠেকাতে তাদের মনিটরিং টিম শেষ দিন পর্যন্ত সক্রিয় ছিল।
সব মিলিয়ে, ঈদের আনন্দ যখন দোরগোড়ায়, তখন উদ্বৃত্ত পশু ও কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ার হতাশায় সাতক্ষীরার হাজারো খামারি ও বিক্রেতার এবারের ঈদ কাটছে গভীর দুঃশ্চিন্তায়।