Sunday 08 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিক্রি করতে না পেরে লাখো চামড়া রাস্তায় ফেলে গেলেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৮ জুন ২০২৫ ১৯:০২ | আপডেট: ৮ জুন ২০২৫ ২১:৫৮

কোরবানির পশুর চামড়ার নির্ধারিত দাম না পেয়ে বিক্রি করতে এসে ফেলে গেছেন অনেক চামড়া বিক্রেতা। রোববার চট্টগ্রাম নগরীর আতুরার ডিপো থেকে তোলা -ছবি: শ্যামল নন্দী

চট্টগ্রাম ব্যুরো: জেলায় কাঁচা চামড়া নিয়ে ছয় বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। গত ২০১৯ সালে কাঁচা চামড়ার ‘অস্বাভাবিক দরপতন’ হয়েছিল, বিক্রি করতে না পেরে মৌসুমী সংগ্রহকারীরা রাস্তায় ফেলে বিদায় নিয়েছিল। ছয় বছর পর আবারও একই পরিস্থিতিতে তাদের চোখের পানি ফেলে বিদায় নিতে হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরীর আতুরার ডিপো এলাকায় ছোট-বড় ২২৫টি আড়তে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা হয়। নগরী ও বিশেষ করে উপজেলা থেকে মৌসুমী সংগ্রহকারীরা কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করে সেখানে নিয়ে আসেন। আড়তদারের প্রতিনিধিরাও নগরীর বিভিন্ন স্পটে গিয়ে মৌসুমী সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ করেন।

বিজ্ঞাপন

এবারও উপজেলা থেকে মৌসুমী সংগ্রহকারীরা চামড়া নিয়ে আড়তে এসেছিলেন। কিন্তু রোববার (৮ জুন) সকালে তারা চামড়া রাস্তায় ফেলে চলে যান। আতুরার ডিপোসহ আশপাশের এলাকায় বিপুল পরিমাণ নষ্ট হয়ে যাওয়া চামড়া সড়ক থেকে অপসারণ করেছেন পরিচ্ছন্ন কর্মীরা।

একইভাবে নগরীর চৌমুহনী, দেওয়ানহাট, মুরাদপুরসহ আরও বিভিন্ন এলাকায় সড়ক থেকে নষ্ট চামড়া অপসারণ করতে হয়েছে পরিচ্ছন্ন কর্মীদের।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হিসেবে, আনুমানিক ৮০ হাজার থেকে এক লাখ কাঁচা চামড়া সড়কে নষ্ট হয়েছে।

মৌসুমী সংগ্রহকারীরা অভিযোগ করেছেন, আড়তদারেরা বা তাদের প্রতিনিধিরা গভীর রাতে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে কাঁচা চামড়া কেনার জন্য দরদাম শুরু করেন। ১০০-২০০ টাকার বেশি দর তারা দিতে আগ্রহী ছিলেন না। সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা পর্যন্ত দর উঠেছিল বড় গরুর চামড়া।

অথচ মৌসুমী সংগ্রহকারীরা একেকটি বড় গরুর চামড়া কিনেছিলেন ৫০০-৭০০ টাকায়। শেষপর্যন্ত দাম না পেয়ে অনেকে চামড়া বিক্রি না করে ডাস্টবিনে ফেলে দেন, অনেকে সড়কে রেখে যান, অনেকে মাটিতে পুঁতে ফেলেন।

রোববার চট্টগ্রাম নগরীর আতুরার ডিপো থেকে তোলা -ছবি: শ্যামল নন্দী

আড়তদারদের বক্তব্য হচ্ছে, সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দর নির্ধারণ করে দিয়েছিল। মৌসুমী সংগ্রহকারীরা সেই দর অনুযায়ী লবণ ছাড়া কাঁচা চামড়া কেনেন। তাদের দাম মেনে তাদের কাছ থেকে চামড়া কিনলে আড়তদারদের লোকসান হত। এছাড়া মৌসুমী সংগ্রহকারীরা দর ধরে রেখেছিলেন, এজন্য শেষ পর্যন্ত অনেকে বিক্রি করতে পারেন নি।

নগরীর চৌমুহনী কর্ণফুলী মার্কেট এলাকায় ৩০ বছর ধরে কোরবানির ঈদে কাঁচা চামড়া কিনে আড়তদারের কাছে বিক্রি করেন আলম সওদাগর।

পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আলম সওদাগর সারাবাংলাকে বলেন, ‘সারাদিন আড়তদারের আশায় বসেছিলাম। রাত ১টার পর তাদের লোকজন এল। তখন চামড়া পচে যাবার উপক্রম। ১০০ টাকা থেকে দরদাম শুরু করেন, তা-ও বড় আর মাঝারি গরুর চামড়া। এক লাখ টাকা বা লাখের নিচে যেসব গরুর চামড়া, সেগুলো কিনবে না, ফ্রি দিলে নেবে।’

‘শেষপর্যন্ত সর্বোচ্চ দর উঠেছে ২০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত। আমি হাজারখানেক বড় আর মাঝারি গরুর চামড়া কিনেছিলাম। ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে কিনেছিলাম। লস দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছি।’

চৌমুহনীতে মৌসুমী সংগ্রহকারীদের অনেকেই বিক্রি করতে না পেরে চামড়া রাস্তায় ফেলে গেছেন বলে তিনি জানান।

অতিরিক্ত দামে চামড়া কেনার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আলম সওদাগর বলেন, ‘সরকার দাম দিয়েছে ১১৫০ টাকা। এটা কী লবণ দেয়া না কি লবণ ছাড়া সেটা তো কোরবানি যারা দেন, তারা বোঝেন না। আমরা চামড়া ৩০০, ৪০০ টাকা বললে তারা সরকারি রেটের কথা বলেন। আমরা কী করবো !’

‘আসলে এটা আড়তদারের কারসাজি ঢাকা দেয়ার জন্য বলা হয়। তারা টার্গেট ফিলআপ করে তারপর মৌসুমী সংগ্রহকারীদের কাছে আসেন। সিন্ডিকেট করে দর ফেলে দিয়ে তারপর চামড়া কেনার নাটক করেন’, – বলেন আলম সওদাগর।

উল্লেখ্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরু ও মহিষের কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অর্থাৎ সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতিটি ১ হাজার ১৫০ টাকা।

জানা গেছে, এবার সিটি করপোরেশনের আপত্তির কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রামগঞ্জ থেকে কাঁচা চামড়া সন্ধ্যা পর্যন্ত তেমনভাবে নগরীতে প্রবেশ করতে দেয়নি।চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে রাত ১০টার পর থেকে আতুরার ডিপো এলাকায় আড়তে আনতে শুরু করেন মৌসুমী সংগ্রহকারীরা। শতাধিক সংগ্রহকারীর কেউ ২০০, কেউ ৫০০, কেউ তার চেয়ে বেশি চামড়া ট্রাক, পিকআপ ভ্যানে করে সেখানে নিয়ে আসেন।

তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাত ৩টার পর আড়তদার বা তাদের প্রতিনিধিরা গিয়ে চামড়া কেনার জন্য দরদাম শুরু করেন। তবে চামড়ার তুলনায় চাহিদা ছিল একেবারে কম। ২০০ টাকার বেশি দর দিতে আগ্রহী ছিলেন না আড়তদার।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা থেকে আসা মোহাম্মদ সবুর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আড়াই লাখ টাকার চামড়া এনেছিলাম। ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে। দরকার নেই বিক্রির। চামড়া ফেলে এসেছি।’

রোববার চট্টগ্রাম নগরীর আতুরার ডিপো থেকে তোলা -ছবি: শ্যামল নন্দী

চট্টগ্রামে কোরবানির কাঁচা চামড়ার বাজার প্রতিবছর ‘চার হাত চক্রে’ নিয়ন্ত্রণ হতো। কোরবানি দাতাদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ করতেন এলাকার উঠতি তরুণ-যুবকরা, যাদের মৌসুমি সংগ্রহকারী বলা হয়। তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে নিতেন বড়-মাঝারি মানের ব্যবসায়ীরা, যারা শুধু কোরবানির সময়ই চামড়া কিনতে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেন এবং সেই চামড়া বিক্রি করেন আড়তদারের কাছে। সেই ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়া বিক্রি করতেন আড়তদারের প্রতিনিধির কাছে। প্রতিনিধির কাছ থেকে চামড়া যেত আড়তদারের ডিপোতে।

তবে সেই ‘চার হাত চক্র’ ২০২০ সাল থেকে ভেঙ্গে যায়। ২০১৯ সালে আড়তদার ও তাদের প্রতিনিধিরা ‘অস্বাভাবিক দরপতন’ ঘটিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কেনা বন্ধ রেখেছিলেন। এতে কাঁচা চামড়া সড়কে ফেলে দিয়ে তাদের বিদায় নিতে হয়েছিল। ২০২০ সালে মৌসুমি সংগ্রহকারীর সংখ্যা অর্ধেকেরও কমে নেমে আসে। এরপর তিন বছর কার্যত মাঠ থেকে ‘আউট’ হয়ে যান মৌসুমি সংগ্রহকারীরা।

এর ফলে কাঁচা চামড়ার বাজারের ওপর একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন আড়তদার ও তাদের প্রতিনিধিরা। কিন্তু ২০২২ সালে এসে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও কেনাবেচার নিয়ন্ত্রণ নেয় সুন্নী মতাদর্শে বিশ্বাসী সংগঠন ‘গাউছিয়া কমিটি’, যা অব্যাহত ছিল এবার চতুর্থ বছরেও।

গাউছিয়া কমিটি এবারও এক লাখ চামড়া সংগ্রহ করেছে। এছাড়া বিভিন্ন মাদরাসায় তাদের নিজস্ব উদ্যোগেও চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতি এবার চার থেকে সাড়ে চার লাখ চামড়া সংগ্রহের টার্গেট নিয়েছিল।

সূত্রমতে, চট্টগ্রাম নগরী থেকে দেড় লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেন আড়তদারেরা। গাউছিয়া কমিটির সংগ্রহ করা চামড়া, মাদরাসার চামড়া মিলিয়ে টার্গেট পূরণ হয়ে যাবার পর আড়তদারেরা মৌসুমী সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে আর চামড়া কেনায় আগ্রহ দেখাননি। এমনকি চামড়া যখন রাস্তায় নষ্ট হচ্ছিল, তখন আড়তদারেরা প্রশাসনের চাপ এড়াতে আড়ত ছেড়ে একপ্রকার পালিয়ে যান।

আড়তদার সমিতির সাবেক সভাপতি মুসলিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের টার্গেট যা ছিল চামড়া কেনার, সেটা পূরণ হয়েছে। মৌসুমী ব্যবসায়ীদের আমরা আগেই বলেছিলাম, ইচ্ছেমতো দাম দিয়ে চামড়া না কেনার জন্য। এরপরও তারা কিনেছেন, আবার দরও ধরে রেখেছেন। সেজন্য কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা প্রণব কুমার শর্ম্মা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আতুরার ডিপোতে প্রচুর চামড়া নষ্ট হয়েছে। এরপর চৌমুহনীতে পেয়েছি, দেওয়ানহাটে পেয়েছি, মুরাদপুরে পেয়েছি। সবগুলো অপসারণ করা হয়েছে। ৭০-৮০ হাজারের বেশি চামড়া আমরা আবর্জনাগারে নিয়ে ফেলেছি।’

সারাবাংলা/আরডি/আরএস

কোরবানির পশুর চামড়া

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর