চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দেয়া হয় হালদা নদীর একটি শাখা খালে। সেই নষ্ট চামড়ার বর্জ্য গিয়ে মিশেছে নদীর পানিতে। এতে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র মারাত্মক দূষণের কবলে পড়ে।
হালদা গবেষকরা জানিয়েছেন, দূষণের কারণে হালদা নদীতে ব্যাপক হারে প্রজনন সক্ষম মাছের (স্থানীয়দের ভাষায় মা মাছ) মৃত্যুর আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলবার (১০ জুন) রাতে কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টি সেই বিপর্যয় থেকে হালদাকে রক্ষা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে এরপরও দূষণের প্রভাব যে নদীতে থাকবে না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এদিকে অধিদফতরের পক্ষ থেকে কোরবানির পশুর নষ্ট চামড়া নদীতে নিক্ষেপকারীদের বিরুদ্ধে ফটিকছড়ি থানায় মামলা দায়ের হয়েছে।

সম্প্রতি হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে মা মাছ। ফাইল ছবি
পুলিশ ও পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদুল আজহার পরের দিন রোববার (৮ জুন) দুপুরে ডাম্প ট্রাকে পশুর চামড়া নিয়ে ফটিকছড়ি উপজেলার রোসাঙ্গিরি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে ‘তেরপারি’ নামে একটি খালের সেতুর ওপর আসেন ৪-৫ জন ব্যক্তি। সেতুর ওপর থেকে খালে চামড়াগুলো ফেলে দ্রুত তারা ওই স্থান ত্যাগ করেন।
স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোজাম্মেল হক চৌধুরী রোববার সন্ধ্যার দিকে ঘটনাস্থলে যান। খালে ভাসমান চামড়া দেখতে পেয়ে তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে শ্রমিক সংগ্রহ করে সেগুলো তোলার ব্যবস্থা করেন। ৬০০ থেকে ৭০০ চামড়া, যেগুলো পচে গিয়ে বর্জ্যে পরিণত হয়েছে, সেগুলো খাল থেকে তুলে স্থানীয় ‘মাদ্রাসাহ-ই-গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারি’ মাদরাসার পাশে দুটি গর্ত করে পুঁতে ফেলেন।
উল্লেখ্য, চামড়া ফেলার ঘটনাস্থল থেকে তেরপারি খাল প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে রাউজান উপজেলার নাদিমপুরে হালদা নদীর সাথে মিশেছে।
পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের গবেষণা কর্মকর্তা মো. আশরাফ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গতকাল (মঙ্গলবার) তেরপারি খাল হয়ে হালদা নদী পর্যন্ত এলাকা পরিদর্শন করেছি। আমরা যেটা জানতে পেরেছি, তেরপার খালে বেশকিছু নষ্ট চামড়া ফেলা হয়। গরুর নাড়িভুঁড়িও কিছু ফেলা হয়েছিল। এর মধ্যে সাতশ’র মতো চামড়া ইউএনও মহোদয় খাল থেকে উদ্ধার করেছেন। আরও চামড়া বা বর্জ্য হয়তো খাল থেকে হালদা নদীতে গিয়ে মিশতে পারে। সামগ্রিকভাবে হালদায় দূষণ পরিস্থিতি আমরা দেখেছি। পরীক্ষার জন্য আমরা পানির নমুনা সংগ্রহ করেছি।’
‘তেরপারি খালের পাশে আরেকটি খালে, সেটাও হালদা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত, সেখানে আমরা কিছু নষ্ট চামড়া, পশুর নাড়িভুঁড়ি, বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখেছি। সেই খালটিতে পানির স্রোত তেমন নেই, যে কারণে বর্জ্যগুলো জমা হয়ে পড়েছিল। আমরা ইউএনও মহোদয়কে বিষয়টি জানিয়েছি, যাতে সেগুলো দ্রুত উদ্ধার করা হয়।’
পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চামড়া ব্যবসায়ীরা (মৌসুমী সংগ্রহকারী) ফটিকছড়ির নানুপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে কোরবানির পর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু যথাযথ দাম না পেয়ে কেউ কেউ সেই চামড়া তেরপারি খালে ফেলে যান। যারা চামড়া ফেলেছেন, তারা ট্রাকের চালক-সহকারী ও শ্রমিক বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে ৫-৬ জন চামড়া ব্যবসায়ী জড়িত।
উল্লেখ্য, এবার চট্টগ্রাম নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলায় কোরাবনির পশুর চামড়া সংগ্রহের পর চাহিদামতো দামে বিক্রি করতে না পেরে অনেক মৌসুমী সংগ্রহকারীকে সেগুলো ফেলে দিতে হয়েছে। অনেকে সড়কে-নদীতে ফেলেছেন, অনেকে মাটিচাপা দিয়েছেন। সিটি করপোরেশনের হিসেবমতে, শুধুমাত্র চট্টগ্রাম নগরীতেই প্রায় লাখখানেক নষ্ট চামড়া সড়ক থেকে সংগ্রহ করে আবর্জনাগারে ফেলা হয়েছে।
কোরবানির পশুর চামড়া ফেলাসহ তিন কারণে হালদা নদীতে দূষণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়া। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘হালদা এবং তার শাখা নদী-খালপাড়ের মানুষ গরু কোরবানির পর অনেক চামড়া বিক্রি কিংবা হস্তান্তর করতে না পেরে মাটিচাপা না দিয়ে সেগুলো নদী-খালে ফেলেছে।’
‘এবার মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর ফলে নদী-খাল সংলগ্ন জলাশয় ও জমিতে পানি জমে গিয়েছিল। সেই পানি নেমে যাবার সময় এর সঙ্গে মিশে যাওয়া গৃহস্থালি ও পোলট্রি ফার্মের বর্জ্য গিয়ে পড়ে খাল-নদীতে, যা শেষপর্যন্ত হালদায় গিয়ে মিশেছে। এরপর ঈদের টানা বন্ধের সুযোগ নিয়ে হালদা পাড়ের কিছু কারখানা তাদের বর্জ্য নদীতে ছেড়ে দিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। মূলত. এই তিনটি কারণে হালদা নদীতে ভয়াবহ দূষণ পরিস্থিতি তৈরি হয়।’
তবে এর মধ্যে পশুর বর্জ্য সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব তৈরি করেছে জানিয়ে চবি’র প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘কোরবানীর বর্জ্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করেছে। পশুর চামড়া, রক্ত, ও গরুর নাড়িভুঁড়ি পচে পানিতে অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড ও অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করে, দ্রবীভূত অক্সিজেন কমিয়ে দেয়। আবার গৃহস্থালি বর্জ্যও পচে পানিতে প্রচুর অ্যামোনিয়া তৈরি করে।’
পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরাসরি তেরপারি খালে চামড়া ফেলার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে হালদা নদী দূষণ করা হয়েছে। এতে নদীর কার্প (রুই) জাতীয় মাছ এবং উদ্ভিদসহ সকল প্রাণির জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করেছে।
হালদা নদীর জলজ জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধন করায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৪ (২) ও ৯ (১) ধারায় পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের গবেষণা কর্মকর্তা মো. আশরাফ উদ্দিন মঙ্গলবার (১০ জুন) ফটিকছড়ি থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলার বিষয়টি ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুর মোহাম্মদ সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন।
পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ইউএনও মহোদয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছি। ফেসবুকে খালে চামড়া ফেলার যে ভিডিও আছে, সেটাও দেখেছি। কিন্তু যারা চামড়া ফেলেছেন, তাদের কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। কেউই তাদের নাম-পরিচয় আমাদের জানাতে পারেননি। এজন্য বিবাদীদের নাম-পরিচয় উল্লেখ করা যায়নি। অজ্ঞাতনামা ৫-৬ জনসহ নির্দেশদাতা আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছি।’
হালদা গবেষকরা আশঙ্কা করেছিলেন, কোরবানির বর্জ্যজনিত দূষণের কারণে হালদা নদীতে ব্যাপক হারে প্রজনন সক্ষম মাছের মৃত্যু হবে। তবে মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকে রাত পর্যন্ত বৃষ্টির কারণে সেই বিপর্যয় থেকে রক্ষা মিলেছে বলে ধারণা তাদের।
অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘মারাত্মক অ্যামোনিয়া দূষণযুক্ত পানির কারণে মা মাছের মৃত্যুর আশঙ্কা করেছিলাম। কারণ, হালদা নদীর পানির রঙ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। পাড়ের লোকজন জানিয়েছেন, গত ২০-৩০ বছরে তারা পানির এমন রঙ দেখেননি। এটা দূষণের প্রভাবে হয়েছিল।’
‘২০২০ সালে এই অ্যামোনিয়াযুক্ত পানির কারণে মা মাছসহ প্রায় ২২ প্রজাতির মাছ মারা গিয়েছিল। তখন পানিতে অ্যামোনিয়ার স্বাভাবিক মাত্রা থাকার কথা ছিল ০.০২ পিপিএম, সেখানে হালদা নদীর পানিতে পাওয়া গিয়েছিল ২.৮ পিপিএম। গত বছরও একই কারণে হালদায় বেশ কয়েকটি মা মাছ মারা যায়। এবারও সেই আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু গতকাল (মঙ্গলবার) রাত পর্যন্ত কয়েক ঘন্টার বৃষ্টি যেটা হয়েছে, সেটা বাঁচিয়ে দিয়েছে। আল্লাহর রহমতে দূষণের প্রভাব কমেছে বা কেটে গেছে বলা যায়। মা মাছের প্রাণহানির শঙ্কাও আপাতত নেই। এরপরও পুরোপুরি কেটেছে, এটা বলছি না। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।’
পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে হালদা নদীর মাছগুলো রক্ষা পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’
চট্টগ্রামের রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার প্রায় ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে আছে হালদা নদী। প্রতি বছর চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ্য মাসের মধ্যে পূর্ণিমা-অমাবস্যার তিথিতে বজ্রসহ বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নামে হালদা নদীতে। আর তখনই তাপমাত্রা অনুকূলে থাকলে ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মাছ। সাধারণত মধ্য এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে হালদায় ডিম ছাড়ে মা মাছ।
এ বছরও গত ২৯ মে হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে মা মাছ। এবার প্রায় ১৪ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে।
হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী,২০২২ সালে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি, ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। ২০২০ সালে হালদা নদীতে রেকর্ড পরিমাণ ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৯ সালে প্রায় সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে স্থানীয়রা ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ২২ হাজার ৬৮০ কেজি।
এর আগে ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।
এছাড়া ২০২৩ সালে ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি ও ২০২৪ সালে ১ হাজার ৬৮০ কেজি (নমুনা) ডিম সংগ্রহ হয়েছিল।