চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঈদুল আজহার টানা সরকারি ছুটির প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ধস নেমেছে। বন্দরে গড়ে দৈনিক প্রায় পাঁচ হাজার কনটেইনার জাহাজ থেকে খালাস হয়। কিন্তু বন্ধের মধ্যে সেটা অর্ধেকেরও কমে নেমে এসেছে। একইসঙ্গে বন্দর থেকে কনটেইনার ডেলিভারি ও রফতানি কনটেইনার প্রবেশও কমে গেছে।
এতে বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে ও জেটিতে জাহাজের গড় অবস্থানকাল বেড়েছে। বর্হিনোঙ্গরে পণ্য খালাসের জন্য অপেক্ষমাণ জাহাজের জট তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি বন্দরের অভ্যন্তরেও কনটেইনার জট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ছুটি শেষে এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বৃহস্পতিবার (১২ জুন) থেকে জাহাজ ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। বন্ধের মধ্যে যেভাবে জাহাজ ও কনটেইনার জটের আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেভাবে হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার ও মেরিন) ক্যাপ্টেন আহমেদ আমিন আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল (বুধবার) পর্যন্ত কনটেইনার ডেলিভারিতে একটু সমস্যা ছিল। তবে আমরা স্মুথলি জাহাজ থেকে খালাস করে গেছি। বৃহস্পতিবার পরিস্থিতি অনেকটাই ডেভেলপ করেছে। বন্দরের অভ্যন্তরে ৪১ হাজার বা তার কিছু বেশি কনটেইনার আছে। আমাদের স্পেস এখনও পর্যাপ্ত আছে। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বর্হিনোঙ্গরে মাত্র ১১টি জাহাজ ওয়েটিংয়ে আছে। ছুটি শেষ হওয়ার পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে গত ৫ জুন থেকে সরকারি ছুটি শুরু হয়েছে, যা ১৪ জুন পর্যন্ত চলবে। এত দীর্ঘ ছুটির কারণে বন্দরে অপারেশনাল কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরি এবং আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে মারাত্মক প্রভাবের আশঙ্কা করে আসছিলেন বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা।
এ আশঙ্কাকে আমলে নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ ঈদুল আজহার টানা ছুটিতে সম্ভাব্য অচলাবস্থা মোকাবিলায় ১০টি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ সিদ্ধান্তের আলোকে চট্টগ্রাম বন্দরে শুধুমাত্র ঈদের দিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ ছিল। কিন্তু এরপর থেকে আগের মতোই ২৪ ঘণ্টা সচল আছে বন্দর।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছুটিতে শ্রমিক সংকটে বন্দর কর্তৃপক্ষের নেওয়া সিদ্ধান্তের সুফল আসেনি। কনটেইনার ডেলিভারি কমে যাওয়ায় জাহাজকে জেটিতে অতিরিক্ত একদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে ৫৩ হাজার টিইইউস (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একক হিসেবে) কনটেইনার রাখার জায়গা আছে। তবে ৪০ হাজার টিইইউসের বেশি কনটেইনার ডেলিভারির জন্য বন্দরের ভেতরে অপেক্ষমাণ থাকলে স্বাভাবিক কার্যক্রমে প্রভাব পড়ে এবং দ্রুত জট পরিস্থিতির আশঙ্কা তৈরি হয়।
ঈদের ছুটি শুরুর সপ্তাহখানেক আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের কর্মবিরতির প্রভাব পড়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। ২৭ মে পর্যন্ত প্রায় ৪৩ হাজার কনটেইনার বন্দরে ডেলিভারির জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। এ ছাড়া জেটিতে ভেড়ার জন্য জাহাজের অবস্থানকাল পাঁচ থেকে সাতদিনে গিয়ে ঠেকেছিল।
তবে এনবিআরে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাস ও ডেলিভারি ত্বরান্বিত করে। এতে ঈদুল আজহার আগে বন্দরের ভেতরে কনটেইনারের পরিমাণ ৩৬ হাজার টিইইউসে নেমে আসে।
তবে টানা বন্ধের কারণে গত এক সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনারের পরিমাণ আবারও ৪০ হাজার পেরিয়ে গেছে।
সূত্রমতে, ছুটি শুরুর দিন গত ৫ জুন বন্দরে কনটেইনার ডেলিভারি হয়েছিল ৪ হাজার ১২২ টিইইউস। এদিন জাহাজে রফতানি কনটেইনার তোলা হয়েছিল ৯ হাজার ৭২০ টিইইউস আর আমদানি কনটেইনার জাহাজ থেকে নামানো হয়েছিল ৫ হাজার ৪১১ টিইইউস।

চট্টগ্রাম বন্দর। ফাইল ছবি
কিন্তু ঈদুল আজহার আগের দিন ৬ জুন থেকে পরিস্থিতি পালটাতে থাকে। এদিন মাত্র ৫২১ টিইইউস কনটেইনার ডেলিভারি হয়। ঈদের দিন ৭ জুন বিকেল ৪টা থেকে অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হলেও বন্দর থেকে কোনো কনটেইনার ডেলিভারি হয়নি। তবে কনটেইনার জাহাজ থেকে ডেলিভারি হয় ৩০৮ টিইইউস।
ঈদের পরদিন ৮ জুনও কোনো কনটেইনার ডেলিভারি হয়নি। ৯ জুন ৪৩১ টিইইউস ডেলিভারি হয়েছে। এরপর গত মঙ্গলবার (১০ জুন) চলতি মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৫৭৫ টিইইউস কনটেইনার জাহাজ থেকে খালাস হয়, এর বিপরীতে ডেলিভারি হয় ১ হাজার ৩৮১ টিইইউস। বুধবার (১১ জুন) ডেলিভারি হয়েছে ১ হাজার ৭৮১ টিইইউস।
ঈদের ছুটিতে জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাসের পরিমাণও কমেছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন আমদানি কনটেইনার নামানো হয় ৫ হাজারের মতো। কিন্তু ৫ জুন থেকে ১০ জুন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৫৪৪ টিইইউস এবং সর্বনিম্ন ২ হাজার ৩১১ টিইইউস আমদানি কনটেইনার জাহাজ থেকে খালাস হয়েছে।
মঙ্গলবার (১০ জুন) পর্যন্ত বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনার ছিল ৩৮ হাজার ৫২ টিইইউস। বুধবার কনটেইনার ছিল ৪০ হাজার ৬৬১ টিইইউস।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল ও চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হক বলেন, ‘কনটেইনার ডেলিভারি কম হচ্ছে। এতে অবশ্য আমরা খালাসে বেশি মনযোগ দিতে পারছি। এটা একটা পজেটিভ ইমপ্যাক্ট। ডেলিভারিও যে একেবারে সর্বনিম্নে নেমেছে এমন নয়। আমরা প্রথম দুই-তিনদিন বাদ দিলে গড়ে ১৩০০ করে কনটেইনার ডেলিভারি করছি। আমাদের ধারণক্ষমতা এখনও ভালো আছে।’
তবে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডা’র তথ্য অনুযায়ী, ঈদের টানা ছুটিতে শ্রমিক সংকটের কারণে ৩০ শতাংশ রফতানি কনটেইনার ডিপো থেকে বন্দরে পৌঁছানো যায়নি। ঈদের দিন এবং পরদিন ডিপো থেকে কোনো কনটেইনার ডেলিভারি হয়নি। এরপর গত চারদিনে সর্বোচ্চ ১৪৭টি ও সর্বনিম্ন ২০টি কনটেইনার ডেলিভারি হয়েছে। অথচ স্বাভাবিক সময়ে ডিপো থেকে দুই হাজারের ওপর রফতানি কনটেইনার বন্দরে নিয়ে জাহাজে তোলা হয়।
এ অবস্থায় জাহাজে পণ্য বোঝাই ও খালাসের সময় অতিরিক্ত লাগছে। ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার বদলে জেটিতে জাহাজের গড় অবস্থানকাল অতিরিক্ত আরও ২৪ ঘণ্টায় গিয়ে ঠেকেছে। স্বাভাবিক সময়ে বর্হিনোঙ্গরে ২৫-২৬টি জাহাজ জেটিতে ভেড়ার জন্য অপেক্ষমাণ থাকে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সেটা ৫৩টি-তে পৌঁছে।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, ‘ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্দর ও ডিপো থেকে কনটেইনার ডেলিভারি অসম্ভব বেড়ে যাবে। যে চাপ তৈরি হবে, সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় হবে বন্দরের জন্য আসল চ্যালেঞ্জ। তখন ডিপো থেকে বন্দরে কনটেইনার পৌঁছানো নিয়ে আমরা বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হবো বলে আশঙ্কা করছি।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার ও মেরিন) ক্যাপ্টেন আহমেদ আমিন আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেসরকারি ডিপো থেকে আমরা ভালো রেসপন্স পেতে শুরু করেছি। আজকের (বৃহস্পতিবার) পরিস্থিতি তুলনামূলক বেটার। হিসেবটা আমরা কাল (শুক্রবার) জানাতে পারবো। রোববার (১৫ জুন) থেকে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হবে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলা অলরেডি করতে শুরু করেছি।’