ঢাকা: জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম একসপ্তাহ পুরোপুরি বন্ধ থাকার পর আংশিকভাবে চালু হয় জরুরি বিভাগ। এর ছয়দিন পর হাসপাতালের আউটডোরে সেবা কার্যক্রম শুরু করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই সময়টাতে সাধারণ মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে হাসপাতালটিতে ভর্তি থাকা জুলাই আন্দোলনে আহতদের। আসলেই কি তারা এই ঘটনায় দায়ী! নাকি জুলাই আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার নেপথ্যে ‘রাজনীতি’! নাকি সুস্থ হওয়ার পরও জোড় খাটিয়ে হাসপাতালটিতে খুঁটি গেড়ে বসেছেন তারা! এমনই নানান প্রশ্ন জনমনে।
চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে গত ২৮ মে হঠাৎ করেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে জুলাই আন্দোলনে আহতদের। এ সময় সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন তুলে হাসপাতাল ছাড়েন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারী। এতে বন্ধ হয়ে যায় হাসপাতালটির সেবা কার্যক্রম। ফলে হাসপাতালটিতে ভর্তি থাকা অন্যান্য সাধারণ রোগীরা অনেকেই বাধ্য হয়ে ছাড়েন এই হাসপাতাল। আবার কেউ কেউ হাসপাতালটিতে ভর্তি থেকে অন্য হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ মে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের চিকিৎসকসহ অন্যান্যরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এমনকি, রোগীদের অন্য হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতেও বলে মন্ত্রণালয়। হাসপাতালের অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে একটি প্রতিনিধিদল পাঠান মন্ত্রণালয়। প্রতিনিধিদল আহতদের সঙ্গে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ অন্যান্য সেবাদানকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা করেন। এরপর দফায় দফায় বৈঠক হয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে। পরে ৪ জুন খুলে দেওয়া হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগ।
এরপর ওইদিন জুলাই আহত ৩০ জনের চোখ পরীক্ষা করার পর তাদের সবাইকে ছাড়পত্র দিলে সেটি ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে আহত ইমরান হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাড়পত্রে পরবর্তীতে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেতে চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের নাম ছিল না এবং এই হাসপাতালে আমাদের জন্য কোনো চিকিৎসা নেই এমনটাই বলা হয়েছে। চক্ষুবিজ্ঞানে যদি চিকিৎসা না থাকে তাহলে অন্য তিন হাসপাতালের (পিজি, ইস্পাহানি ও সিএমএস) নাম কেন উল্লেখ করা হয়েছে। এটা জানতে চাইলে আমাদের কর্তৃপক্ষ জানায়- ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে। আমরা তখন বলেছি, স্যার ছাড়পত্রে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান লিখে দেন, তাহলে আমরা এই হাসপাতালের ফলোআপে থাকতে পারি। কিন্তু ওপর থেকে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত লিখবে না বলে আমাদের জানায়। ১১ মাস ধরে যে চিকিৎসক আমাদের চিকিৎসা দিয়ে গেছে এখন যদি বলে চক্ষুবিজ্ঞানে চিকিৎসা নাই ওই তিন হাসপাতালে চিকিৎসা আছে, এটা একটা রহস্যজনক। এমনকি আমাদের ফাইলও লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল। আমাদের পুনর্বাসন, চিকিৎসা ও জুলাই সনদ নিশ্চিত করে দেওয়া হোক, আমরা চলে যাবো।’

আহত ইমরান হোসেন। ছবি: সারাবাংলা
হেলথ কার্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হেলথ কার্ডে কোনো সুযোগ সুবিধা দেখছি না। কিশোরগঞ্জ সদরে একটি হাসপাতালে হেলথ কার্ড নিয়ে গেলে তারা কোনো সুবিধা দিতে চায়নি। পরে অনেক জোরাজুরির পর ৩০ শতাংশ কমিয়েছে। তাহলে বিনামূল্যের জন্য দেওয়া এই হেলথ কার্ডের কি দরকার। হেলথ কার্ডে শুধু সরকারি হাসপাতালের কথা বলা হয়েছে কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের কথা উল্লেখ করা হয়নি। আর আমাদের যে ভাতা দেওয়ার কথা সেটি এখনও চালু করা হয়নি।’
জুলাই আহতরা হাতপাতাল বন্ধ করে দখলে নিয়েছে- এমন প্রশ্নে ইমরান বলেন, ‘আমরা হাসপাতাল বন্ধ করার কেউ না। আমরা কোনো নেতা না, সাধারণ মানুষ। তারা নিজেরাই হাসপাতালে আসেননি। এটা তাদের নিজেদের ব্যর্থতা। যে পাঁচজন বিষ খেয়েছিল তাদের ডেকে বলা হয়- হাসপাতাল খুলে দিলে তোমাদের রিস্ক নিতে হবে? মনে করেন আমরা চলে গেলাম- তারপর হাসপাতালে কোনো দুর্ঘটনা ঘটল, সেটির দায়ভার কি আমরা নিব? আমরা চাই হাসপাতাল খোলা থাকুক।’
যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ডে আহত হয়ে চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে ভর্তি আছেন মো. নুর আলম। এখনও হাসপাতালে থাকার বিষয়ে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার সারা শরীরে ২৫০টার মতো স্প্লিন্টার আছে, পুরুষাঙ্গেও আছে। আমার দুই চোখেই সমস্যা। বাম চোখে দেখি না, ডান চোখে কিছুটা দেখি। আমরা চিকিৎসকদের বলছি যে লিখিত দেন কোনো চিকিৎসা আর নাই। আমরা চলে যাবো। পটুয়াখালি থেকে আমার প্রতিদিন আসা সম্ভব না। এখানে আমার সঙ্গে রিয়াদ নামের একজন ছিল, তাকে বলেছিল কন্ডিশন ভালো না, চোখ তুলে ফেলতে হবে। কিন্তু ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে সে এখন সুস্থ। তার মানে এখানে ভালো চিকিৎসা না দিয়ে আমাদের মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে। তাই বলেছি আপনারা না পারলে আমাদের বিদেশে পাঠান। হাসপাতালের অনেকেই অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। সেগুলো নিয়ে কথা বলায় ক্ষোভ থেকে পরিকল্পিতভাবে আমাদের ওপর হামলা করেছে।’

আহত মো. নুর আলম। ছবি: সারাবাংলা
এদিকে, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে ১১০০ জুলাই আহতরা চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি আছেন ৪৭ জন। বাকিরা ফলোআপে থেকে নিচ্ছেন। ভর্তি ৪৭ জনের মধ্যে এখন হাসপাতালে অবস্থান করছেন ৬ জন, বাকিরা ঈদে যে যার বাড়িতে গিয়েছেন। জুলাই আন্দোলনে চোখে ক্ষত নিয়ে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ১১০০ জনের মধ্যে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছেন ২১ জন। আর দুই চোখেই সমস্যা এমন রয়েছেন ২৭ জন, তবে ধীরে ধীরে তাদেরও চোখের আলো কমে আসছে বলে জানান আহতরা।
সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জুলাই আহতদের থাকার জন্য যে বেড দেওয়া হয়েছে, সেখানে মাত্র ৬ জন অবস্থান করছেন। আর কেউ বর্তমানে না থাকায় বেডগুলো খালি পড়ে আছে। এ ছাড়া, হাসপাপতালটির নিরাপত্তায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। কেউ ভেতরে ঢুকতে চাইলে গেট থেকে বলা হচ্ছে হাসপাতাল বন্ধ।
চক্ষুবিজ্ঞানে হাসপাতালে জুলাই আহতদের সমন্বয়ক নাবিলা চৌধুরী নাদিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আহতদের চোখে বিভিন্ন সময়ে অপারেশন করা লাগে, কারো কারো চোখে ১৩ বারও অপারেশন করা হয়েছে। যারা সিলেট বা অন্য দূর-দূরান্ত থেকে আসে, তাদের পক্ষে সম্ভব না চিকিৎসা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে যাওয়া। তাদের তো এতটুকু সুবিধা আমরা দিতেই পারি যে এখানে থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে যাবে। তারা আজ ১১ মাস ধরে হাসপাতালে পড়ে থাকবে কেন? ভালোভাবে চিকিৎসা দিন যাতে সবাই দ্রুত যে যার বাসায় চলে যেতে পারেন। আর ছাড়পত্র ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা ঘটেনি। ছাড়পত্র (পিজি, ইস্পাহানি ও সিএমএস) অন্য হাসপাতালের নাম থাকলেও চোখের জন্য চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এটা নিয়েই বিতর্ক।’

চক্ষুবিজ্ঞানে হাসপাতালে জুলাই আহতদের সমন্বয়ক নাবিলা চৌধুরী নাদিয়া। ছবি: সারাবাংলা
তিনি আরও বলেন, ‘স্টাফরা আগে হামলা করার পরই সংঘর্ষ ঘটেছিল। রাজনৈতিকভাবে জুলাই আহতদের হয়রানি করা হচ্ছে। জুলাই যোদ্ধারা কোথাও নিরাপদ না, এলাকায় ধরে মারতেছে। আর হেলথ কার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছেনা বলে ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া ও বরিশাল থেকে ফোন আসছে যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না।’
সংঘর্ষের সৃষ্টি ও হাসপাতাল বন্ধের কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাসাপাতালটিতে জুলাই আহতদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক কৌশল শুরু হয়ে গেছে। তাই দুটি পক্ষ হয়ে গেছে জুলাই আহতরা। আর সেখানেই তৃতীয় কোনো পক্ষ মদদ দিয়ে একটা পক্ষকে উসকিয়ে দিতে চাইছেন। আর এই দুই গ্রুপের মধ্যে একটা গ্রুপের সাতজন শীঘ্রই তুরস্কে যাচ্ছেন। আর তাদেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে উঠেছে আহত কোরবান শেখ হিল্লোলের নাম। জুলাই আহতদের বুঝিয়ে হাসপাতালটিতে ফলোয়াপে রেখে কর্তৃপক্ষ ও সরকার থেকে তাদের বাড়ি পাঠানো সম্ভব। কিন্তু জুলাই আহতদের প্রশ্নবিদ্ধ করতে যোগসাজশ হয়ে কাজ করছে একটি গ্রুপ। এ ছাড়া, মারামারির ঘটনাটি ঈদের ছুটির কাছাকাছি সময়ে হওয়ায় সেটাকে সুযোগ হিসেবে বেছে নেয় হাসপাতালের কর্মচারীরা। এটা কাজে লাগিয়ে অনেকেই জুলাই আহতরা হাসপাতালটি খুলতে দিচ্ছে না বলে অপ্রচারও চালাতে থাকে।
এ বিষয়ে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘শনিবার (১৪ জুন) থেকে পুরোপুরিভাবে হাসপাতাল চালু হবে। আগের মতোই আবার রোগীদেখা শুরু হবে। এখনও অনেক রোগী আসছেন, আমারা তাদের চিকিৎসা দিচ্ছি। আর কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে হচ্ছে।’

হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলম। ছবি: সারাবাংলা
জুলাই আহতরা হাসপাতালটি খুলতে দিচ্ছে না এবং তারা দখলে নিয়েছে এমন অভিযোগগুলো সত্য কিনা জানতে চাইলে ছুটিতে থাকা হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতাল খুলতে কেউই বাধা দেয়নি। অনেকদিন ধরে কর্মচারীদের সঙ্গে ছোটখাটো মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং চলছিল, সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২৮ মে। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একটু নিরাপত্তাহীনতা বোধ করায় কাজে যোগদান করেনি। সবাই ভাবতেছিল কাজ করার জন্য নিরাপদ কিনা। কিন্তু জুলাই আহতরা কোনো বাধা দেয়নি। আগামীকাল শনিবার থেকে হাসপাতালের সব বিভাগের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চালু হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আশা করছি কোনো সমস্যা হবে না।’

ঈদে আহতদের অনেকে বাড়ি যাওয়ায় বেডগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। ছবি: সারাবাংলা
জুলাই আহতরা হাসপাতাল দখলে নিয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যারা বলে এটা, সেটা তাদের ধারণা থেকে। এটাও ঠিক চোখের রোগীদের সাধারণত এক-দুদিন পর আর হাসপাতালে থাকার দরকার হয় না। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রটা ভিন্ন। তারা যখন নিজের এলাকায় যাবে তখন তারা চিন্তা করে হঠাৎ যদি চোখ লাল হয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের মতো তো চিকিৎসা পাবো না। তারপর যে ওষুধ চক্ষুবিজ্ঞান থেকে দেওয়া হয় সেটা অনেক ভালো, যা এলাকায় পাবে না মনে করে। এরপর নিরাপত্তার ইস্যু রয়েছে; একটা ছেলে চাঁদপুরে থাকে, সে গ্রামের বাড়িতে গেলে মোটরসাইলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া, এখানে থাকলে গেজেটে নাম অর্ন্তভুক্তকরণ, অনুদান সংগ্রহ, হেলথ কার্ড ও ভাতা পাওয়া সহজ হবে বলে তারা মনে করেন। আসলে মাল্টিপারপাস ইস্যু জড়িত রয়েছে।’