ঢাকা: সরকার দেশের সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের জন্য হাতেগোনা কয়েকটি কর্মসূচি গ্রহণ করলেও পথশিশুদেরও প্রায় ৯৪ শতাংশ সরকারের কোনো রকমের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। পথে বেড়ে উঠা শিশুদের ৫৮ শতাংশেরই জন্মসনদ নেই যার ফলে তারা শিক্ষার অধিকারসহ সরকার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এমনই তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশের এক জরিপে।
মঙ্গলবার (১৭ জুন) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে কারিতাস বাংলাদেশ আয়োজিত মিডিয়া পরামর্শ সভায় জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী শহরের ৬৬৭ জন পথশিশু ও বস্তি এলাকায় বসবাসরত ১ হাজার ২৪৬টি পরিবারের ওপর জরিপ পরিচালিত হয়।
কারিতাস বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি অফিসার রবিউল আলম জরিপের ফলাফল তুলে ধরে বলেন, ‘জরিপে অংশগ্রহণকারী পথশিশুদের ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ (৩৮৮ জন) শিশুর জন্মসনদ নেই। জন্মসনদ না থাকা এসব শিশুদের ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ নিজের পিতামাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) নম্বর জানে না। যার ফলে জন্ম নিবন্ধন করতে তারা নানা সমস্যার মধ্যে পড়ছেন।
জরিপের পথশিশুদের শিক্ষার বিষয়েও হতাশাজনক চিত্র উঠে আসে। জরিপে অংশ নেওয়া মোট শিশুর মধ্যে ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ বর্তমানে স্কুল/মাদরাসায় পড়ছে না। সরকারে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে অংশগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যা মাত্র ৫ দশমিক ৭ শতাংশ (৩৮ জন); বাকি প্রায় ৯৪ দশমিক ৩ শতাংশ পথশিশু সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া বস্তি এলাকায় বসবাসরত ১ হাজার ২৪৬টি পরিবারের মধ্যে ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার নিম্নবিত্ত শ্রেণির (১২,৫০০ টাকার নিচে আয়), এসব পরিবারের ৯১ দশমিক ৭ শতাংশ কোনো সরকারি সুরক্ষা সুবিধা পায়নি। এসব পরিবারগুলোর মধ্যে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশে পথশিশু হয়ে যায়। বস্তি এলাকায় বসবাসরত ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবারের সব শিশুদের জন্মসনদ থাকলেও ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবারের কোনো শিশুরই জন্মসনদ নেই বলে জরিপে উঠে আসে।
সভায় পথশিশুদের প্রতিনিধিরা তারা নিজেদের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন।
তারা বলেন, ‘আমরা সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ও অবহেলিত অংশ। আমাদের খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমরা নানা সময়ে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হই। সরকার যদি আমাদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ না করে, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমরা চাই-ভাতার আওতায় আমাদের অন্তর্ভুক্তি, জন্মসনদ প্রদান, নিরাপদ আশ্রয়, মানসম্মত শিক্ষা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা।’
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে আসা এক পথশিশু বলেন, ‘মা-বাবা মারামারি করতো। খাবার পেতাম না। একপর্যায়ে মা-বাবা বিচ্ছেদ হয়ে গেলে অসহায় হয়ে পড়ি। এখন আমাদের একটাই দাবি, জন্মসনদ চাই। সরকারের সুযোগ সুবিধা চাই।
সভায় কারিতাস বাংলাদেশ পক্ষে সংস্থার পরিচালক (কর্মসূচি) দাউদ জীবন দাশ সরকার ও বেসরকারি সংস্থার প্রতি কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরে বলেন, ‘পিতামাতাহীন শিশুদের জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজকরণ এবং প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওয়ার্ড ভিত্তিক ক্যাম্পেইন চালিয়ে শতভাগ জন্ম নিবন্ধন নিশ্চিতকরণ; শিশু জন্মের পরপরই হাসপাতাল/কমিউনিটি ক্লিনিকে জন্ম নিবন্ধন সম্পন্ন করার ব্যবস্থা চালু করা; পথশিশুদের রাস্তা থেকে ফেরাতে বিশেষ কর্মসূচি চালু করা, যার মধ্যে শর্তযুক্ত ভাতা অন্তর্ভুক্ত থাকবে যাতে পরিবার শিশুর জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে; শিশুশ্রম বন্ধ এবং শিশুশ্রম ও অন্যান্য কারণে ঝরে পড়া শিশুদের শনাক্ত করে তাদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা; পথশিশুদের শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা যেন এসব শিশুরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শিক্ষা চলমান। রাখে, দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা ভাতার পরিমাণ বাস্তবসম্মতভাবে বৃদ্ধি করা ও আবেদন প্রক্রিয়া সহজকরণ।’
দাউদ জীবন দাশ বলেন, ‘সরকারের নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় যে অল্পসংখ্যক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আছেন তারা যে ভাতা পাচ্ছেন তা খুবই নগণ্য। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় মাসিক ৫০০-৬৫০ টাকা ভাতা কখনো বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী নয়। অন্যদিকে পথ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিও হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি। দেশে যে পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা রয়েছেন তাদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব পরিবার ও রাষ্ট্রের। আমরা যদি এসব শিশুদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়ে যাই তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে আমরা অনেকাংশেই পিছিয়ে যাব। তাই তাদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে অবিলম্বে সরকারসহ আমাদের সবার নজর দিতে হবে।’