ঢাকা: ৯ ডিসেম্বর ২০১২। রাজধানীতে সরকারবিরোধী অবরোধ চলছিল। তবুও সব উপেক্ষা করে জীবিকার তাগিদে কর্মস্থলের দিকে রওনা দেন বিশ্বজিৎ দাস। কিন্তু পথেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নৃশংসতায় খুন হন এই দর্জি দোকানি। দিনের আলোয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর সাংবাদিকদের সামনেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা এ ঘটনার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও কার্যকর হয়নি আসামিদের বিচারের রায়। এমনকি মামলাটি এখনো ঝুলছে আপিল বিভাগে। কোন অদৃশ্য ইশারায় হত্যাকারীদের বিচার থমকে রয়েছে- এমন প্রশ্ন জেগেছে অনেকের মনে। তবে কোনো স্বার্থের কাছে নতজানু না হয়ে নতুন উদ্যমে চাঞ্চল্যকর মামলাটি নিষ্পত্তির উদ্যোগে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
তথ্য বলছে, ওইদিন সকাল থেকেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধ চলছিল। কর্মসূচি ঠেকাতে পুরান ঢাকার রাজপথে নামেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও। এর মধ্যেই সকালে মিছিল বের করেন সরকারবিরোধী আইনজীবীরা। মিছিলটি ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে যেতেই বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আইনজীবীদের ওপর হামলা চালান। ধাওয়া খেয়ে তাদের সঙ্গে পথচারী বিশ্বজিৎও দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না তার। তাকে পিটিয়ে আর কুপিয়ে খুন করেন বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী। নির্মম হত্যার দৃশ্যটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তোলপাড় শুরু হয় গোটা দেশে।
ঘটনার ছবি-ভিডিও দেখে স্বপ্রণোদিত হয়ে জড়িতদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। একইসঙ্গে ছাত্রলীগকর্মীদের গ্রেফতারে নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী ড. মো. ইউনূস আলী আকন্দ। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি করেন তিনি। পরে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি পুলিশকে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
ঠিক একবছর পর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জড়িত ২১ আসামির আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। এরপর মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের শুরু হয় হাইকোর্টে। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট দু’জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। বেকসুর খালাস পান আরও দু’জন। এ ছাড়া, বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আপিলকারী দুজনেরও খালাস মেলে। এ রায় দেন বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।
হাইকোর্টের দেওয়া খালাসের রায় স্থগিত চেয়ে ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু প্রায় আট বছর হতে চললেও আবেদনের এখনো শুনানি হয়নি। আসেনি আপিল বিভাগের কজলিস্ট বা কার্যতালিকায়ও। এমনটিই জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
বর্তমানে মৃত্যুদণ্ডের সাজা নিয়ে কারাগারে রয়েছেন ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল। একই দণ্ডে দণ্ডিত রাজন তালুকদার এখনো ধোরাছোঁয়ার বাইরে। এ ছাড়া, হাইকোর্টের রায়ে ফাঁসির দণ্ড থেকে রেহাই পেয়েছেন সাইফুল ইসলাম ও কাইয়ুম মিয়া। ২০১৭ সালে তারা কারামুক্ত হন। একই সময়ে বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পান যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এএইচএম কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফা। আর মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন সাজা পেয়ে জেলে রয়েছেন মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ইমদাদুল হক এমদাদ ও জিএম রাশেদুজ্জামান শাওন। মীর মো. নূরে আলম লিমন এখনও পলাতক।
চাঞ্চল্যকর এ মামলায় ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তারেক বিন জোহর, ইমরান হোসেন, আলাউদ্দিন ও খন্দকার ইউনুস আলী। তবে এখনও অধরা ছাত্রলীগ নেতা আজিজুর রহমান, ওবায়দুল কাদের তাহসিন, আল আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল ও মোশাররফ হোসেন।
সূত্রমতে, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত পলাতকরা কে কোথায়, সবই জানে পুলিশ। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শ ও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আড়ালে রয়েছেন তারা। তাদের গ্রেফতারে রাষ্ট্রীয় তেমন চাপ না থাকায় পুলিশও এ মামলায় গুরুত্ব দিচ্ছে না। এতে সুযোগ পাচ্ছেন আসামিরা। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবে বিচারিক আদালতের রায়ে উচ্চ আদালতে অনেকের সাজা কমে যায়। কেউ কেউ বেকসুর খালাসও পান। মূলত এ মামলার শুরু থেকেই পুলিশি তৎপরতায় গাফিলতি ছিল বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. মো. ইউনূস আলী আকন্দ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হওয়ায় গ্রেফতারে অনেকটা গড়িমসি করে পুলিশ। নিজেদের চোখের সামনে সবকিছু ঘটলেও শুরুতে তারা কাউকে আইনের আওতায় আনতে পারেননি। এক পর্যায়ে জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করি। ঘটনার সময় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে রুল জারির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দাবিও জানানো হয়। এরপর ধীরে ধীরে এ মামলার কিছুটা অগ্রগতি চোখে পড়ে। তবে এতবছরেও আসামিদের ফাঁসি কার্যকর না হওয়ায় শঙ্কায় রয়েছে ভুক্তভোগীর পরিবার।
আইনজীবী মনোয়ার পাটোয়ারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় লুকোচুরির কিছু নেই। সাক্ষ্যপ্রমাণও সাজানো ছিল না। কেননা প্রকাশ্যে দিবালোকে সবকিছু ঘটেছে। কিন্তু ছবি-ভিডিও থাকা সত্ত্বেও বিচারিক আদালতের রায়ের সাজা কমিয়ে ফেলেন উচ্চ আদালত, যা হতাশ হওয়ার মতোই ছিল।’
তিনি বলেন,‘ন্যায়বিচার পাওয়া নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হলেও বিশ্বজিতের পরিবার পুরোপুরি বঞ্চিত। কারণ দু’জনের ফাঁসির দণ্ড বহাল থাকলেও কার্যকর হয়নি। আদৌ হবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। কেননা মামলাটি আপিল বিভাগেই ঝুলে রয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’ আসলে অভিযুক্তরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হওয়ার কারণেই আইনের ফাঁকফোকরে ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন বলেও মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটার পর জড়িতদের দ্রুত বিচারে সোচ্চার ছিলেন সারাদেশের মানুষ। কিন্তু আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকায় বিচারের অগ্রগতি নিশ্চিত হওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও গ্রেফতারে টালবাহানা শুরু করেন। এসবের প্রভাব পড়ে বিচার অঙ্গনে। ফলে এ মামলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নতুন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন পুলিশ কিংবা অন্য সব বাহিনীর সদস্যরা।’
এ মামলায় পুলিশ মূল ‘স্টেকহোল্ডার’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ চাইলে খুব সহজেই অপরাধীদের ধরতে পারে। কিন্তু বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার ক্ষেত্রে তাদের অবহেলা সবচেয়ে বেশি। এ কারণে সাজাপ্রাপ্তরা এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর এসবের যৌক্তিক ব্যাখ্যাও তাদের কাছে নেই। আসলে ক্ষমতার পালাবদল হলেও কিছু সিস্টেম আগের মতোই চলছে। ফলে আসামিরা পার পেয়ে আরও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহিতা আরও নিশ্চিত করতে হবে।’
ড. তৌহিদুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার চাইলে আলোচিত এ মামলা নিয়ে নতুন নির্দেশনা দিতে পারে। তাহলে আসামিদের গ্রেফতারে আরও তৎপর হবে পুলিশ। একইসঙ্গে এ নিয়ে আদালতে রিভিউ করা যেতে পারে। গণমাধ্যমের ভূমিকাও বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ, গণমাধ্যম সোচ্চার হলে অনেক অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। এ ছাড়া, ঘটনার তদন্তের সঙ্গে জড়িতদের গাফিলতি থাকলেও জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।’ তাহলেই বিশ্বজিতের পরিবার সুবিচার পাবে বলে আশাবাদী এই বিশেষজ্ঞ।