Thursday 19 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অভিযোগ
ইরাকের বিরুদ্ধে খেলার পুনরাবৃত্তি কি ঘটতে যাচ্ছে ইরানে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২০ জুন ২০২৫ ০০:০৪

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার দাবি করছেন, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, যা বর্তমান ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের তীব্রতা বাড়াচ্ছে। তবে, ইরান বরাবরই তাদের পরমাণু কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করে আসছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এবং খোদ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়ন ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর দাবির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

তাহলে, সত্যিই কি ইরান পরমাণু বোমা তৈরির দোরগোড়ায়? নাকি ২০০৩ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অস্তিত্বহীন অভিযোগের মতো এবারও একই খেলার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? বুধবার (১৮ জুন) আল-জাজিরার প্রতিবেদক যশরাজ শর্মা এবং জন টি সারোপোলোস এ সম্পর্কিত একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। এখানে সেই প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো।

বিজ্ঞাপন

কানাডার জি৭ সম্মেলন থেকে মঙ্গলবার (১৭ জুন) দ্রুত ফিরে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ‘খুব কাছাকাছি’ পৌঁছে গেছে। ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের মধ্যে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ইরানবিরোধী হুমকি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টের সঙ্গে তার এই মন্তব্য সঙ্গতিপূর্ণ।

শুক্রবার (১৪ জুন) থেকে ইসরায়েল ইরানের শীর্ষ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়েছে এবং অন্তত ১৪ জন ইরানি পারমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনীর দাবি, এই বিজ্ঞানীরা ‘ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র বিকাশে মূল ভূমিকা রেখেছিলেন’ এবং ‘তাদের নির্মূল করা গণবিধ্বংসী অস্ত্র (ডব্লিউএমডি) অর্জনের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর সক্ষমতার ওপর একটি উল্লেখযোগ্য আঘাত।’

তবে, ইরান জোর দিয়ে বলেছে যে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত। তারা সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে দেওয়া ফতোয়াকে তাদের দাবির সমর্থনে তুলে ধরে।

এদিকে ট্রাম্পের মন্তব্য সোমবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে করা দাবিরই প্রতিধ্বনি। নেতানিয়াহু এই সংঘাতের সময়ও এই দাবিগুলো পুনরাবৃত্তি করে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের ন্যায্যতা প্রমাণ করছেন। তিনি শুক্রবার বলেছিলেন, ‘সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইরান এমন পদক্ষেপ নিয়েছে, যা তারা আগে কখনো নেয়নি; ইউরেনিয়ামকে অস্ত্র বানানোর পদক্ষেপ।’

তাহলে কি সত্যিই ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির কাছাকাছি, যেমনটা ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু দাবি করছেন? এবং ইরানের বিরুদ্ধে বর্তমান অভিযোগগুলোর সঙ্গে ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা চালাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দ্বারা অস্তিত্বহীন গণবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রতারণামূলক অভিযোগের মধ্যে কি কোনো মিল রয়েছে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা এবং জাতিসংঘের পারমাণবিক নজরদারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর তথ্য ও মূল্যায়নগুলো খতিয়ে দেখা যাক।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা কী বলছে

গত ২৫ মার্চ, ট্রাম্পের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে অগ্রসর হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থা (আইসি) এই মূল্যায়ন অব্যাহত রেখেছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না এবং সর্বোচ্চ নেতা খামেনি ২০০৩ সালে স্থগিত করা পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির অনুমোদন দেননি।’

তবে গ্যাবার্ড আরও বলেন, ‘ইরানে প্রকাশ্যে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়েছে, যা সম্ভবত ইরানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের সমর্থকদের উৎসাহিত করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে এবং পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন কোনো রাষ্ট্রের জন্য এটি নজিরবিহীন।’

যখন সাংবাদিকরা গ্যাবার্ডের বক্তব্য ট্রাম্পকে উদ্ধৃত করেন, তখন ট্রাম্প বলেন, ‘সে কী বলেছে আমি পরোয়া করি না। আমি মনে করি তারা পারমাণবিক অস্ত্রের খুব কাছাকাছি ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারে না। এটা খুবই সহজ।’

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মূল্যায়ন

ইসরায়েল ইরানে হামলা চালানোর তিন দিন আগে গত ১০ জুন মার্কিন সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের কমান্ডার এরিক কুরিলা একটি সিনেট কমিটিকে বলেছিলেন, তেহরান ‘একটি পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।’ এই মূল্যায়ন গ্যাবার্ডের মূল্যায়নের সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে অসঙ্গতিপূর্ণ। তবে কুরিলা স্পষ্ট করে বলেননি যে, মার্কিন সামরিক বাহিনী মনে করে ইরানের বর্তমানে পারমাণবিক বোমা তৈরির কোনো কর্মসূচি রয়েছে। বরং, বলেছে এটি এমন একটি স্তরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

তিনি ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের উচ্চমাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ একটি বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির আড়ালে সারাদেশে জমা হচ্ছে। এ ছাড়া, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন অব্যাহত রেখেছে।‘

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও ইরানের কার্যক্রম

ইরান ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধতা পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা এবং তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সমালোচকদের উদ্বিগ্ন করেছে।

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ হলো- প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামে ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপের ঘনত্ব বাড়ানোর প্রক্রিয়া। একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে, ইউরেনিয়ামকে প্রায় ৯০ শতাংশ ইউ-২৩৫ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করতে হবে, যা ‘অস্ত্র-গ্রেড’ হিসেবে বিবেচিত। ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম অস্ত্র-গ্রেডে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় সময় কমিয়ে দেয়, তাই উচ্চ সমৃদ্ধকরণ মাত্রা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার মতো নজরদারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অধিকতর যাচাই-বাছাই প্রত্যাশা করে।

ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের অনুসরণ অস্বীকার করে এবং পারমাণবিক অপ্রসারণ চুক্তি (NPT)-এর সইকারী হিসাবে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি বিকাশের, যার মধ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণও রয়েছে, তার বৈধ অধিকারের ওপর জোর দেয়।

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা কি মনে করে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে?

৯ জুন জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি জানান, ইরান ৬০০ কেজি (৮৮০ পাউন্ড) ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করেছে। তিনি বলেন, ‘যদিও সুরক্ষিত সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম নিজেই নিষিদ্ধ নয়, তবে ইরান বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন রাষ্ট্র যারা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন ও সংগ্রহ করছে, এটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।’

১৩ জুন ইসরায়েলের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলার একদিন আগে, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি বোর্ড তেহরানকে নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করে এবং জাতিসংঘের সংস্থার প্রতি তার সুরক্ষা-সম্পর্কিত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। তবে ১৭ জুন সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গ্রোসি জোর দিয়ে বলেন, ইরানের কথিত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের কারণে তার সংস্থা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি যে, তেহরান বোমা তৈরি করছে। তিনি বলেন, ‘আমরা পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়ার কোনো পদ্ধতিগত প্রচেষ্টার প্রমাণ পাইনি।’

ইরান কত তাড়াতাড়ি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে?

১০ জুন কুরিলা দাবি করেন যে, ইরান যদি ‘পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার’ সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তাদের কাছে ‘প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে’ ২৫ কেজি (৫৫ পাউন্ড) অস্ত্র-গ্রেড ইউরেনিয়াম এবং তিন সপ্তাহের মধ্যে ১০টি পর্যন্ত অস্ত্র তৈরির জন্য পর্যাপ্ত মজুদ ও সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে। তবে গ্রোসি, সিএনএন সাক্ষাৎকারে, একটি ভিন্ন সময়রেখা প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই, এটা কালকের জন্য ছিল না, হয়তো কয়েক বছরের ব্যাপারও নয়।’

মার্কিনভিত্তিক অলাভজনক আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের অপ্রসারণ নীতির পরিচালক কেলসি ডেভেনপোর্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ইসরায়েলও জানে যে ইরানের বোমা তৈরির কোনো আসন্ন ক্ষমতা নেই। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘যদি সত্যিই একটি আসন্ন বিস্তার ঝুঁকি থাকত, যদি ইসরায়েল সত্যিই মনে করত যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। তবে আমি মনে করি ফোর্দো এবং নাতানজ সাইটের অন্যান্য কার্যক্রম ব্যাহত করার জন্য আরও দীর্ঘস্থায়ী অভিযান চালানো হতো।’

২০০৩ সালের গণবিধ্বংসী অস্ত্র (WMD) বিতর্কের প্রতিধ্বনি?

মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকজন পর্যবেক্ষকের কাছে, বর্তমান বিতর্কে ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণের পূর্ববর্তী গণবিধ্বংসী অস্ত্র বিতর্কের একটি প্রতিধ্বনি রয়েছে। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য দাবি করেছিল যে, ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে। যার মধ্যে রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্র রয়েছে এবং এটি একটি পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি অনুসরণ করছে।

এই দাবিগুলো আগ্রাসনের ন্যায্যতা প্রমাণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তবে, আক্রমণের পর, ব্যাপক অনুসন্ধানে ইরাকে কোনো সক্রিয় গণবিধ্বংসী অস্ত্র কর্মসূচি পাওয়া যায়নি। পরবর্তী তদন্তে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, গোয়েন্দা তথ্যগুলো গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ ছিল এবং নেতাদের দ্বারা আগ্রাসনের পক্ষে একটি ভিত্তি তৈরি করার জন্য ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য রাজনীতি করা হয়েছিল।

সারাবাংলা/এইচআই/পিটিএম

অভিযোগ ইরাক ইরান ইসরায়েল গণবিধ্বংসী অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর