Monday 23 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইরানের হরমুজ প্রণালী বন্ধের ঘোষণা
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল সংকটের আশঙ্কা

ভাষান্তর: নুসরাত তনু
২৩ জুন ২০২৫ ২২:১৮ | আপডেট: ২৩ জুন ২০২৫ ২৩:১৭

হরমুজ প্রণালীর ম্যাপ। ছবি: সংগৃহীত

চলমান যুদ্ধের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত সমুদ্রপথ হরমুজ প্রণালী বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ইরান। দেশটির সংসদ থেকে এমন ঘোষণা আসার পর নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। তেলসমৃদ্ধ এই অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা প্রণালীটি বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি পরিবহণ রুটগুলোর অন্যতম। যেখান দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল নিয়ে জাহাজগুলো পার হয়। এই পথটি ইরানের অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এই প্রণালীটি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে চাপে রাখার শক্তিশালী কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে ইরান।

হরমুজ প্রণালী কী

হরমুজ প্রণালী (Strait of Hormuz) হলো বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহণ নৌপথগুলোর একটি। এটি মধ্যপ্রাচ্যের দু’টি দেশ ইরান (উত্তরে) এবং ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (দক্ষিণে) মাঝে অবস্থিত। প্রণালীটি পারস্য উপসাগরকে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ মাত্র ৩৩ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং একদিকে ঢোকার এবং আরেকদিকে বের হওয়ার জন্য তিন কিলোমিটার করে দুটি শিপিং লেন রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় তেল ট্যাংকারগুলো এই পথ দিয়েই প্রতিদিন যাতায়াত করে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশ্লেষক সংস্থা ইআইএ-এর তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ সালে প্রতিদিন প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই পথ দিয়ে পরিবহণ করা হয়েছে, যা বিশ্বে সমুদ্রপথে পরিবাহিত মোট তেলের এক-চতুর্থাংশ এবং বৈশ্বিক ব্যবহারের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।

ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব

হরমুজ প্রণালীর উত্তরের উপকূলে রয়েছে ইরান। এর ভৌগলিক অবস্থান ও সামরিক উপস্থিতির কারণে ইরান একে কৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। ইরানের অর্থনীতির বড় একটি অংশ তেল রফতানির ওপর নির্ভরশীল। তারা মূলত চীন ও কিছু এশিয়ান দেশে ছাড়কৃত মূল্যে তেল রফতানি করে এবং সেই রফতানির ৯০ শতাংশ যায় এই হরমুজ পথ দিয়েই।

২০২৫ সালের মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে ইরান রফতানি করেছে ৬৭ বিলিয়ন ডলারের তেল, যা তাদের জন্য এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ আয়। এই অবস্থান থেকে বোঝা যায়, হরমুজ শুধু কৌশলগত অস্ত্র নয়, ইরানের অর্থনৈতিক লাইফলাইনও বটে। ইরানের জাতীয় সংসদের নিরাপত্তা কমিশনের সদস্য এমপি এসমাইল কোসারি বলেছেন, ‘আমরা হরমুজ প্রণালী বন্ধের বিষয়টি গুরুতরভাবে পর্যালোচনা করছি। প্রয়োজন হলে সচেতনতার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

বিশ্বব্যাপী বিশ্লেষকদের মতে, ইরান যদি সত্যিই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয় তাহলে পুরো পৃথিবীর অর্থনীতিতে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যাবে। একদিনেই প্রতি ব্যারেলে দাম বাড়তে পারে ৫০-১০০ ডলার পর্যন্ত। বিশেষ করে চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া- যারা এই অঞ্চলের তেলের ওপর নির্ভরশীল, তারা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। বিশ্ববাজারে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়বে এবং মূল্য পতন ঘটবে বিভিন্ন খাতে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রফতানিকারক সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ইরাক ও ইউএই- সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য পণ্যের দামের ওপরেও এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে। একে একপ্রকার বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির ঢেউ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

প্রণালী বন্ধ হলে বিকল্প যা হতে পারে

হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা কতটা সম্ভব ও টেকসই হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সামরিক দিক থেকে দেখা গেলে, যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর বাহরাইনে অবস্থান করছে, যা এই অঞ্চলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম। ২২ জুন (রোববার) মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিও বলেছেন, ‘যদি তারা (ইরান) হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে, সেটি হবে অর্থনৈতিক আত্মহত্যা। এটি তাদের জন্য সবচেয়ে বড় ভুল। আমরা চীনকেও এতে বাধা দিতে বলছি।’

যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, প্রণালীতে নৌ চলাচলে বাধা দিলে তারা তাৎক্ষণিক সামরিক জবাব দেবে। ইরান এমন হুমকি অতীতেও দিয়েছে, কিন্তু কখনও পুরোপুরি কার্যকর করেনি। কারণ, এটি করলে নিজের বন্ধু দেশ যেমন চীনের উপরও চাপ বাড়বে, কারণ চীনের বড় অংশ তেল আসে এখান দিয়েই।

হরমুজ প্রণালী নিয়ে ইরানের সিদ্ধান্তে আইএমএফ-এর মহাপরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়োভা বলেছেন, ‘যদি প্রণালীতে তালা পড়ে, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি খর্ব হবে; তেলের দাম স্থিতিশীল থাকবে না।’

বিশ্ববাজারে কিছু বিকল্প পথ থাকলেও, যেমন সৌদি আরবের ইস্ট-ওয়েস্ট পাইপলাইন বা ইউএই-এর আবু ধাবি-ফুজাইরাহ পাইপলাইন, তা মোট তেলের চাহিদার ছোট একটি অংশই পূরণ করতে সক্ষম। ফলে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে সেই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়।

পরিস্থিতির বাস্তবতা বলছে, ইরান সম্পূর্ণভাবে হরমুজ বন্ধ করে দেওয়ার চেয়ে বরং এটি একটি কৌশলগত রাজনৈতিক চাপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। বর্তমানে ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা, গাজায় চলমান যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি- সব মিলিয়ে ইরানের এমন হুমকিকে কৌশলগত বার্তা হিসেবেই দেখছে বিশ্লেষকরা।

হরমুজ প্রণালী এখন কেবল একটি সমুদ্রপথ নয়, বরং এটি পরিণত হয়েছে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির এক জটিল দ্বন্দ্বস্থলে। এই পথ ঘিরে যেকোনো সংঘর্ষ বা নিষেধাজ্ঞা পুরো বিশ্বকে নিয়ে যেতে পারে অস্থিরতা ও মূল্যস্ফীতির এক নতুন যুগে।

সারাবাংলা/এনজে/পিটিএম

ইরান জ্বালানি সংকট হরমুজ প্রণালী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর