ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ১০ দিন পার হয়েছে। এতদিন এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান কিছুটা আড়াল করে রাখলেও ২২ জুন ইরানের তিনটি পারবাণবিক স্থাপনায় হামলার মধ্য দিয়ে সরাসরি নিজেদের সম্পৃক্ততা জানান দিয়েছে। তবে, এই হামলার পর এখন আরেক শক্তিধর রাশিয়া তার মিত্র ইরানের পাশে দাঁড়াবে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাশিয়ার জন্য কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তেলের উচ্চমূল্য থেকে অর্থ উপার্জন ও ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে বিশ্ব মনোযোগ সরিয়ে রাখা, নাকি দীর্ঘ বছর ধরে এই অঞ্চলে গড়ে ওঠা সম্পর্ক ও চুক্তিগুলো হারানোর ভয়?
ইউরোনিউজের আলেকজান্ডার কাজাকেভিচ এক বিশেষ প্রতিবেদনে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও এতে মার্কিন সংশ্লিষ্টতায় রাশিয়ার অবস্থান তুলে ধরেছেন। তাতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এ সংঘাতের প্রভাবও উঠে এসেছে। কাজাকেভিচের প্রতিবেদন বলছে, ২২ জুন ইরানে মার্কিন বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছে। যদিও রাশিয়া নিজেই ইউক্রেনে হামলা জোরদার করছে।
ক্রেমলিন জানিয়েছে, মার্কিন হামলা ‘আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘের সনদ এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনাগুলোর লঙ্ঘন, যা পূর্বে এ ধরনের পদক্ষেপকে অগ্রহণযোগ্য বলে চিহ্নিত করেছে। বিশেষভাবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, হামলাগুলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য একটি দেশ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।’ মার্কিন হামলার কথা উল্লেখ করে মস্কো বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা আগ্রাসন বন্ধ করার এবং পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রচেষ্টা জোরদারের আহ্বান জানাচ্ছি।’
এদিকে ওয়াশিংটনে হামলার আগে সেন্ট পিটার্সবার্গ ফোরামে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, ‘ইসরায়েলের বিমান অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ইরান সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেনি।’ রুশ প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘মস্কো ও তেহরানের মধ্যে ব্যাপক অংশীদারিত্ব চুক্তিতে সামরিক ক্ষেত্র সম্পর্কিত কোনো ধারা নেই।’ তবে রাশিয়া ইরানে তৈরি শাহেদ-১৩৬ ড্রোন (ওরফে জেরানিয়াম-২) উৎপাদন করছে।
‘অল ইরান: দ্য প্যারাডক্সেস অফ লাইফ ইন অ্যান অটোক্র্যাসি আন্ডার স্যাঙ্কশনস’ বইয়ের লেখক নিকিতা স্মাগিন বলেছেন, ‘রুশ পক্ষ এর আগে জোর দিয়ে বলেছে, ইরানের সঙ্গে তাদের জোট ‘সামরিক জোট’ নয়। তাই মস্কো সামরিক সহায়তা দিতে বাধ্য নয়। এটি যৌক্তিক যে, ইরানে যা ঘটছে তাতে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করবে না। কারণ, তারা ইরানের স্বার্থে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে চায় না।’
স্মাগিন উল্লেখ করেছেন, ‘মার্কিন হামলার আগে তেহরানের মস্কোর কাছে সামরিক হস্তক্ষেপের অনুরোধ না করাটা আশ্চর্যের কিছু নয়।’ তিনি বলেন, ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র শুরু থেকেই সার্বভৌমত্বের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছিল। ইরানি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের পেছনের অন্যতম চালিকা শক্তি ছিল বিদেশি খেলোয়াড়দের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।’
স্মাগিন বলেন, ‘এই অর্থে, ইরান কখনই রাশিয়ার কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করেনি এবং এখন করছে না। কারণ, তারা কিছু সার্বভৌমত্ব হারানোর ভয় পায় বা তাদের কিছু সার্বভৌমত্ব রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিতে চায় না, যেমনটা বাশার আল-আসাদের ক্ষেত্রে হয়েছিল।’ তবে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারেন বলেও তার ধারণা। তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘শুধুমাত্র এই কারণে পুতিনকে বিষয়গুলো কিছুটা উদ্বিগ্ন করছে।’
‘স্বৈরাচারী নেতাদের’ পরিণতি রাশিয়াকে বিচলিত করে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, ওয়াশিংটন ঠিক জানে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি কোথায় লুকিয়ে আছেন। ইরানি নেতা একটি সহজ লক্ষ্য, তবে তারা তাকে হত্যা করবে না, অন্তত এখন নয়। যদি ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শাসনের পতন ঘটে বা যদি আয়াতুল্লাহকে হত্যা করা হয়, তাহলে ক্রেমলিন এর প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে? রুশ কর্তৃপক্ষের জন্য এর অর্থ কী হবে? নিকিতা স্মাগিন উল্লেখ করেছেন, ‘সাধারণত, আমরা দেখি যে, বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় মৃত্যু, স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপ্রধানদের ধ্বংস সাধারণত রুশ পক্ষকে বিচলিত করে। আমরা মনে করতে পারি, পুতিন কীভাবে গাদ্দাফির হত্যাকাণ্ডে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।’
তিনি বলেন, “বিদ্রোহীরা প্রাথমিকভাবে সেখানে কাজ করছিল। তবে, বিদেশি বাহিনীর, যার মধ্যে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এবং আমিরাতও ছিল, তাদের সহায়তা ছাড়া নয়। তবে, এই পুরো বিষয়টি পুতিনের জন্য একটি গুরুতর ‘সতর্ক সংকেত’ হিসাবে দেখা গেছে। এবং দৃশ্যত, এটির একটি কারণ ছিল যে, তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার অবস্থান পরিবর্তন করতে শুরু করেছিলেন।’ বিশ্লেষকের মতে, যদি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ভেঙে যায়, তাহলে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে রাশিয়ায় আশ্রয় দেওয়া হতে পারে।
নিকিতা স্মাগিন বলেন, ‘এটি একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা। আমি মনে করি না, এটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে যদি খামেনিকে নির্মূল করা হয়, তাহলে ক্রেমলিনে কোনো আনন্দ হবে না। তারা বিশ্বাস করেন যে, নেতাদের হত্যা একটি রেডলাইন, যা ইসরায়েল এরই মধ্যেই অতিক্রম করেছে। উদাহরণস্বরূপ, তারা এরই মধ্যেই হিজবুল্লাহ নেতাদের নির্মূল করেছে।’
তেলের চড়া দামে রাশিয়ার বাজেট সহজ হবে
মধ্যপ্রাচ্যের নতুন সংকট রাশিয়ার এই অঞ্চলের প্রভাবকে আঘাত করতে পারে। তবে আকস্মিক উত্তেজনা ক্রেমলিনের জন্য কিছু সুসংবাদ নিয়ে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, কানাডার জি৭ সম্মেলনে রাশিয়ার তেলের দামের সীমা না কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে বাজার আর অস্থিতিশীল না হয়।
২০২২ সালের শেষ থেকে, মস্কোর ওপর প্রভাব বিস্তারের অন্যতম প্রধান দিক ছিল রাশিয়ান তেলের জন্য প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলার মূল্য নির্ধারণ করা। ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের সাড়ে তিন বছর পর, ইইউ তেলের দামের সীমা প্রতি ব্যারেল ৪৫ ডলার নামানোর প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু আপাতত তা স্থগিত থাকবে। নিকিতা স্মাগিন বলেন, ‘যদি আমরা ইরানে সামগ্রিকভাবে বিচ্ছিন্নতা, বা শাসন পরিবর্তনকে ধরি, তাহলে অবশ্যই এটি দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়ার স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলে।’
বিশ্লেষক ব্যাখ্যা করেন, ‘ক্রেমলিন অবশ্যই স্বল্প মেয়াদে এর থেকে লাভবান হওয়ার আশা করছে; তেলের দাম খুব গুরুতরভাবে বাড়বে। পরিস্থিতি যত খারাপ হবে, দাম তত বেশি হবে এবং রুশ বাজেট প্রণয়ন তত সহজ হবে—এই বছর, যেমনটা মনে হচ্ছে।’ স্মাগিনের মতে, রাশিয়া এই মুহূর্তে লাভবান হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে, শাসন পরিবর্তন এবং ইরানকে কিছু স্থায়ী অস্থিতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দুতে আনা অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কৌশলকে হুমকির মুখে ফেলে।’
তিনি বলেন, ‘ইরান ক্রেমলিনের বহু ক্ষেত্রে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার ছিল। অনেক প্রকল্প এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, ইরানের মাধ্যমে পরিচালিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, পরিবহণ করিডর, উত্তর-দক্ষিণ প্রকল্প, একটি সম্ভাব্য গ্যাস হাব। এই সব ভবিষ্যতের জন্য। তবে, শাসন ব্যবস্থার পতনের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। দীর্ঘমেয়াদে, এটি রুশ পক্ষের জন্য ক্ষতি এবং একধরনের ধাক্কা হবে।’
ইরান থেকে ড্রোন নির্ভরতা কমিয়েছে রাশিয়া
ইউক্রেনে পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়া ইরানি-নকশার ড্রোন উৎপাদনকে ‘স্থানীয়করণ’ করতে সফল হয়েছে। নিকিতা স্মাগিনের মতে, শাহেদ-১৩৬ ড্রোনের সরবরাহকারী হিসাবে ইরানের গুরুত্ব এখন অতীত। দুই দেশের সামরিক সহযোগিতার শিখর ছিল ২০২২ সালে। বিশেষজ্ঞের মতে, গত বছরের শুরুতে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত উপাদান ইরানি ছিল না। তবে ইঞ্জিন ইরান থেকে সরবরাহ করা হয়েছিল। বাকি সবকিছুই রাশিয়ার তৈরি।
তিনি বলেন, ‘এমনকি যদি স্থানীয়করণ এখন ১০০ শতাংশ নাও হয়, এটি তার খুব কাছাকাছি। আমি মনে করি রাশিয়া এটি প্রতিস্থাপনের উপায় খুঁজে পাবে। উল্লেখ্য, শাহেদগুলো আগের মতো বড় ভূমিকা পালন করে না। তবুও, প্রচুর অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন হয়েছে। এই সময়ে রাশিয়া ড্রোনে বিনিয়োগ করেছে। এ ছাড়াও, আমরা যদি বিশেষভাবে শাহেদের কথা বলি, তাহলে এটি আর খুব বেশি ইরানি নয়। জেরান-১ এবং জেরান-২ ড্রোনগুলো ব্যাপকভাবে পুনর্নকশা করা হয়েছে। কারণ, ইরানি সংস্করণ ততটা কার্যকর ছিল না, যতটা অনেকে আশা করেছিল।’
কমের্সান্টের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে কৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্লেষণ কেন্দ্রের পরিচালক রুসলান পুখভ শাহেদগুলোর উড্ডয়ন বৈশিষ্ট্যকে আদিম হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং তাদের ৭ দশমিক ৬২ মিমি অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মেশিনগান দিয়েও ব্যাপকভাবে গুলো করে নামানো সম্ভব। তিনি ইঞ্জিনের শব্দের কথাও লিখেছেন, যা ড্রোনের আগমন সম্পর্কে প্রতিপক্ষকে সতর্ক করে তোলে।
ইসরায়েল রাশিয়ার মধ্যস্থতাকে এখনো ইতিবাচকভাবে দেখছে
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং জেমস মার্টিন সেন্টার ফর ননপ্রলিফারেশন স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ হান্না নোটে লিখেছেন, ইরানকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে রাশিয়ার সবসময় সীমাবদ্ধতা ছিল।
নোটে মার্কিন আউটলেট দ্য আটলান্টিকের জন্য একটি কলামে লিখেছেন, ‘ক্রেমলিনের পশ্চিমাবিরোধী এজেন্ডা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অংশীদার হিসাবে পরিচিতি বাড়িয়েছে, কিন্তু পুতিনের এই অঞ্চলে অন্যান্য স্বার্থ রয়েছে— যেমন ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী, যদিও জটিল, সম্পর্ক এবং ওপেক-এর সঙ্গে তেলের দাম সমন্বয় করার প্রয়োজন— তাই তিনি তেহরানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে ইসরায়েল এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর রেড লাইনগুলো সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন।’
নিকিতা স্মাগিন বিশ্বাস করেন, ইরান ও ইসরায়েলের বর্তমান সংঘাতে রাশিয়া আর ‘অপরিহার্য’ মধ্যস্থতাকারী নয়। তিনি বলেন, ‘যখন পারমাণবিক আলোচনা চলছিল, যখন ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে একটি পারমাণবিক চুক্তি সই করার চেষ্টা করছিলেন, তখন রাশিয়া একটি অপরিহার্য মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করতে পারত। এটি প্রকৃতপক্ষে একমাত্র পক্ষ ছিল যাদের কারিগরি ক্ষমতা ছিল এবং যারা ইরান থেকে অতিরিক্ত ইউরেনিয়াম রফতানি করতে প্রস্তুত ছিল। দৃশ্যত, এই বিষয়টি আলোচ্যসূচি থেকে বাদ গেছে।’