ঢাকা: নয় থেকে চব্বিশ। বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী প্রায় ১৬ বছর। এ সময়টায় ক্ষমতার মসনদে ছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর শাসনামলে গুমের শিকার হয়েছেন বহু মানুষ। এর মধ্যে কেউ হয়েছেন লাশ, কেউ ছিলেন ‘আয়না ঘরে’, আবার কারও হদিস আজও মেলেনি। তবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গেল ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বন্দিশালা তথা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি মিলেছে অনেকের। এর পর থেকেই একে একে বেরিয়ে আসছে ভয়াবহ সব নির্মমতার বর্ণনা।
এসব গুমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল বাংলাদেশ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। নৃশংস এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকের ভিন্নমত থাকলেও সাহস ছিল না মুখ খোলার। চাকরি হারানো কিংবা হয়রানির ভয়ে কিছু না বললেও গুম হওয়া ব্যক্তিদের নির্যাতন দেখে নীরবে কাঁদতেন তারা। কেউ কেউ মানসিক ট্রমায়ও ভুগছেন। এমনই সব তথ্য উঠে এসেছে গুম কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদন। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয় কমিশন।
বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা মিলেছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের আনা-নেয়া করতেন বাংলাদেশ-ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। আদালতের অনুমতি বা নথিভুক্ত মামলা ছাড়াই এ ধরনের কাজ করতেন তারা। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এসব ঘটনা ঘটেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর অনেকেই গুম ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই ব্যক্তি কিংবা পেশাগত দিক থেকে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। গুম নিয়ে নিজের মত প্রকাশসহ আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ম মেনে না চলায় সহকর্মীদের কাছ থেকে পরিকল্পিতভাবে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে এসব কথা তুলে ধরেন ওই কর্মকর্তা।
তিনি জানান, নতুন পোস্টিংয়ের আগেই সহকর্মীদের আগেভাবে সতর্ক করে দেওয়া হতো যেন তাকে বিশ্বাস না করা হয়। তার পরিবারিক যোগাযোগের ওপরও নজরদারি করা হতো। এমনকি মনগড়া অভিযোগ এনে নানাভাবে হয়রানি করা হতো। শুধু তাই নয়, শৃঙ্খলাভঙ্গের দায় এনে পদন্নোতি পাওয়া থেকেও বঞ্চিত করা হয়।
তদন্ত কমিশনের কাছে গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত নিজের ভাইয়ের মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার বর্ণনাও তুলে ধরেন এক তরুণ। তিনি জানান, তার ভাইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শদের তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। চাকরি হারানোর ভয়ে তালিকা জমা দেওয়ার পর সবাইকেই দমন করা হয়। নিজের কারণে এতগুলো মানুষের ক্ষতি দেখে মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে থাকেন গোয়েন্দা সংস্থার ওই সদস্য। চিকিৎসকের শরণাপন্নও হতে হয় তাকে।
এখানেই শেষ নয়, গুমের শিকার এক ব্যক্তি এখন পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে জীবনযাপন করছেন। গুম কমিশনের কাছে নিজের সেই বর্ণনা তুলে ধরেন। তিনি জানান, জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে মারধরের সময় দুটি যন্ত্র ভেঙে যায় সিটিটিসি কর্মকর্তাদের। এর পরও থামেননি তারা। তৃতীয় যন্ত্র দিয়েও নির্যাতন চালানো হয়। সহিংসতার মাত্রা দেখে কাঁদতে কাঁদতে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যান উপস্থিত দুই নারী কর্মকর্তা। অর্ধ-চেতন থাকলেও তাদের কান্নার শব্দ স্পষ্টভাবে শুনতে পান এই ভুক্তভোগী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্মকর্তাদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাও লিখে রাখা হতো। শুধু তাদের নিজেদের নয়, নথিতে আত্মীয়স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। একইসঙ্গে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ, শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অসদাচরণের কথাও তুলে ধরা হতো। বেশ সতর্কতার সঙ্গেই এসব কাজ করতেন বাহিনীর অন্য সদস্যরা।
বহু পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এসব কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু ভয়, চাপ ও প্রতিশোধের আশঙ্কায় কথা বলার সাহস পাননি কেউ। চাকরি হারানো ও পরিবার নিয়ে শঙ্কার কারণে তারা মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এখনও একইভাবে দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিদ্যমান, যা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছে তদন্ত কমিশন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘গেল ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে বহু অপরাধ ঘটেছে। কিন্তু ক্ষমতার পটপরিবর্তন না হলে কেউই এসবের ভয়াবহতা জানতেন না। অবশেষে গুম তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে আমরা কিছুটা হলেও জানতে পেরেছি। এজন্য সংশ্লিষ্টরা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে এখানে বসে থাকলে চলবে না। অপরাধীদের খুঁজে আইনের আওতায় এনে শাস্তি কার্যকর করতে হবে। তাহলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা সামান্যতম হলেও সন্তুষ্ট হবেন।’ এ ছাড়া, ঘৃণ্য এসব কাজ যেন বাংলাদেশে আর পুনরাবৃত্তি না হয়, সে বিষয়টিও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন ড. তৌহিদুল।