Wednesday 25 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গুম কমিশনের প্রতিবেদন
‘তোর আম্মা কান্নাকাটি করতাছে, তাই তোকে দেশে রাখা যাবে না’

রাশেদ মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৫ জুন ২০২৫ ২২:৫৭

গুম। প্রতীকী ছবি

ঢাকা: গুম শুধু নিখোঁজ কিংবা গায়েব নয়, লুকিয়ে রয়েছে ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার কথা। আওয়ামী লীগ শাসনের প্রায় ১৬ বছরে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে দেশে। গুমের পর শুধু ক্রসফায়ারই নয়, নদীতেও ফেলা হয়েছে লাশ। কাউকে আবার ইটভাটার আগুনে পুড়িয়ে ফেলা কিংবা ট্রেন-যানবাহনের নিচে ফেলেও হত্যা করা হয়। আর এসবের পেছনে হাত ছিল বাংলাদেশ-ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের। ওয়াকিবহাল ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। গুম কমিশনের দ্বিতীয় প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।

বেআইনি এসব কর্মকাণ্ডে অনেক কর্মকর্তা অংশ নিতে চাননি। কিন্তু তাদের বিভিন্ন ধরনের ভয় দেখিয়ে বাধ্য করা হয়। এমনকি অস্বীকৃতি বা রাজি না হওয়া কর্মকর্তাদের তথ্য সরাসরি পাঠানো হতো শেখ হাসিনার কাছে। এমন এক ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরা হয় সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে।

বিজ্ঞাপন

এতে বলা হয়, বহুদিন ধরে বন্দি ছিলেন এক ব্যক্তি। একদিন তাকে হত্যার নির্দেশ পান র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত এক কর্মকর্তা। কিন্তু রাজি ছিলেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত ওই ব্যক্তিকে আর মারা হয়নি। ৫ আগস্টের পর হাতে লেখা এ সংক্রান্ত দুটি চিঠি পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বেআইনি কাজে দ্বিমত জানিয়ে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের কাছে চিঠি দুটি লিখেছেন র‌্যাবের দুই কর্মকর্তা।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা মিলেছে। অনেক নাগরিককে গুম করে ভারতীয়দের হাতে তুলে দেওয়া হতো। আবার ভারত থেকেও অনেককে ফিরিয়ে আনা হতো বাংলাদেশে। দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের চাওয়া-পাওয়া অনুযায়ী এসব কর্মকাণ্ড চালানো হতো। আর এ ধরনের কাজকে ‘আন্তঃরাষ্ট্রীয় গুম প্রক্রিয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তদন্ত কমিশন। ভারতে পাচার হওয়া এমন পাঁচজনের জবানবন্দি তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এমন এক ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, সন্দেহভাজন এক ব্যক্তি প্রথমে ভারতীয় গোয়েন্দার হাতে আটক হন। পরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব দেয় ডিজিএফআই। কথামতো তাকে এই দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু ফের মুখোমুখি হতে হয় ডিজিএফআই-র‍্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে। চালানো হয় নির্যাতন। কাউকে কাউকে আবার চিরতরে নিখোঁজ করে ফেলা হয়েছে, যার খোঁজ নেই পরিবারের কাছেও।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের আনা-নেয়া ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে। আর এ সম্পর্ক শুধু মৌখিকই নয়, যৌথ অভিযানে, আন্তঃসীমান্ত সমন্বয়ে ও আইনবহির্ভূত প্রত্যাবর্তন কার্যক্রমেও রূপ নেয়। নিজেদের কীভাবে এক দেশ থেকে আরেক দেশের হেফাজতে হস্তান্তর করা হয়েছিল; এমন বহু বর্ণনা কমিশনের কাছে তুলে ধরেছেন ভুক্তভোগীরা।

এমনই একটি বীভৎস ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এক ব্যক্তি। এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ডিজিএফআইয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্র কমিশনকে নিশ্চিত করেছে বলেও উল্লেখ করা হয়। ওই ভুক্তভোগী জানান, ভারতীয়দের কাছে আটক হওয়ায় একটি প্রশ্নপত্র পাঠান ডিজিএফআই কর্মকর্তারা। আর এসব প্রশ্ন দেখে তাকে জিজ্ঞাসাবদ করা হয়। পরবর্তীতে সেসব উত্তর পাঠানো হয় বাংলাদেশে। এক পর্যায়ে তাকে দেশে আনা হয়। এরপর ডিজিএফআইয়ের হেফাজতে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়।

তদন্ত কমিশনের কাছে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে হস্তান্তরের ঘটনাটি তুলে ধরেন এই ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, ‘রাত দেড়টার দিকে প্রথমে আমার চোখ বাঁধলেন ভারতীয় কর্মকর্তারা। হাতে হাতকড়া পরানো। অস্ত্রসহ রেডি হলেন তারা। এর পর গাড়ি থেকে ১০ মিনিট পরে নামালেন। নামানোর পর বুঝলাম আমাকে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমাকে বলেছে- ‘তুমি বস, তুই বস।’ আমাকে বসিয়ে নিচ দিয়ে পার করেছে।

র‌্যাব থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী আরেক ভুক্তভোগী র‌্যাবের গোয়েন্দা সংস্থা পরিচালিত দুটি কেন্দ্রে বন্দি ছিলেন। তাকেও বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ভারতীয় মুসলমানদের নিয়ে ভিডিও কনটেন্ট পোস্ট করার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গুম হওয়ার এক পর্যায়ে দেশীয় বাহিনীর সদস্যরা এই ভুক্তভোগীকে বলেন, ‘বড় বড় অনেক গোয়েন্দা সংস্থা আছে, আমাদের হাত থেকে নিয়ে তোকে মাইরা ফেলবে। আমাদের কাছে এতদিন ছিলি, তোর ভালোর জন্য তোকে দেশের বাইরে কিছুদিন রাখতে চাই।’

পরে তারা বললেন, ‘তোমার আম্মা অনেক কান্নাকাটি করতাছে। এর জন্য অনেক ছড়াছড়ি হয়েছে। তাই তোমাকে দেশে রাখা যাবে না, দেশের বাইরে পাঠাব আমরা। তোমাকে আমরা ইন্ডিয়া পাঠাব।’ পরদিনই তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে গেল। সীমান্তে মোটরসাইকেলে দু’জন লোক আসেন। তারা বললেন, ‘এরা তোরে পার করে দিব। সেখানে তুই ওই জায়গায় কিছুদিন থাকবি। আবার আমরা তোকে ফিরিয়ে আনব।

ভুক্তভোগী বলেন, ‘যখন আমাকে তুলে দেওয়া হয়, তখন আমার চোখ খোলা ছিল। এরপর একটা নদী পার করানো হলো। নদী পার হওয়ার পর কাঁটাতারের বেড়া ছিল। সেই বেড়া দিয়ে আমাকে পার করে নিয়ে গেলেন তারা। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমাকে বলা হয়, আমরা দিল্লি হেডকোয়ার্টার থেকে আইছি।’

জিজ্ঞাসাবাদে তারা বাংলায় বলেন, ‘তুই কিসের জন্য ভারতবিবোধী ভিডিও ছাড়ছিস?’ আমি বললাম, ‘আমি জানি না, আর আমি কিছু ছাড়িনি। ভারতবিরোধী ভিডিও কিসের জন্য পোস্ট করতাছি, বিশেষ করে কাশ্মীরবিরোধী ভিডিও। মানে মুসলমানদের একটু জুলুম হইতেছে না, ওইটার পক্ষে কিছু বলা হইছে। তারা জিজ্ঞাসা করছে ইন্ডিয়ার প্রসঙ্গে। তারা বলল- এই ভুল জানি আর জীবনে করবা না। এইবারের মতো ছেড়ে দিলাম।’

কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গোপন বন্দিশালায় হিন্দিসহ অন্যান্য বিদেশি ভাষায় কথা বলা ব্যক্তিরাও বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতেন। এর মধ্যে টিএফআইতে দীর্ঘদিন ধরে আটক থাকা এক বন্দি নিজের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি হিন্দি ভাষা বলতে শুনেছি। যখন পরিদর্শনে আসতো, তখন আমাদের দেয়ালের দিকে মুখ করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বসিয়ে রাখতো। সারাদিন নড়াচড়া করতে দিত না। এরপর আমি বুঝতে পারতাম যে, অনেকজন লোক আসছে। পায়ের আওয়াজ শুনতাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রস্রাব-পায়খানার গন্ধ থাকতো সব জায়গায়। হঠাৎ অনেকজন এলে পারফিউমের ঘ্রাণ পেতাম। এর পর মোবাইলের রিংটোন, নোটিফিকেশনের আওয়াজ শোনা যেতো। আর আমাকে ওয়াল ফেসিং দিয়ে রাখতো। আমি বুঝতে পারতাম পেছনে অনেকজন আমাকে দেখছে। একদিন পরিদর্শনের সময় হিন্দি ভাষা শুনেছি। তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে হিন্দি ভাষায় কথা বলছেন।’

নিরাপত্তার স্বার্থে গুম ও নির্যাতনের শিকার এসব ব্যক্তির নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি কমিশন। তবে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সভাপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘গুমের সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত থাকলেও আমাদের কিছু করার নেই। কারণ বিষয়টি আমাদের জুরিসডিকশনের বাইরে। কিন্তু বাংলাদেশিদের বিষয়ে মামলার জন্য পুলিশকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঁচ-ছয়টি মামলার কার্যক্রম চলছে বলেও জানান তিনি।

সারাবাংলা/আরএম/পিটিএম

গুম কমিশন প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর