ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের ১২ দিনের যুদ্ধ আপাতত থেমেছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে ৬২৭ জন ইরানি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও চার হাজার ৭০০ জন।
ইসরায়েলের ব্যাপক সামরিক অভিযানে বিধ্বস্ত ইরান এবং দেশটির ৮৬ বছর বয়সী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একটি বদলে যাওয়া ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় নিজেদের পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে।
ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের প্রভাবশালী বিপ্লবী গার্ডের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র ও মার্কিন ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যদিও ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। খামেনি একটি অজ্ঞাত স্থানে গভীর গোপনীয়তায় ছিলেন এবং মাত্র দুবার ভিডিও বার্তায় দেখা দিয়েছেন, যখন ইসরায়েলি সামরিক বিমান দেশটির আকাশে প্রায় বাধাহীনভাবে অভিযান চালিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সহায়তায় যে বিভিন্ন মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় ছিল, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় এ গোষ্ঠীগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চীন ও রাশিয়া থেকে যেসব বৈদেশিক সমর্থনের প্রত্যাশা ইরানের ছিল, সেগুলো মেলেনি। দেশের ভেতরে পুরনো সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় বিধ্বস্ত অর্থনীতি।

তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় একটি আবাসিক ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়ো হন ইরানি জনগণ। ছবি: সিএনএন
বুধবার (২৫ জুন) ইউরেশিয়া গ্রুপ এক বিশ্লেষণে বলেছে, “ইরানের নেতৃত্ব একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে এবং যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে এখন তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও পুনর্গঠন নিয়ে মনোযোগ দিতে চাইবে।”
আনুগত্য নিশ্চিতকরণ
ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযানে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের কতটা গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছে। তারা অতি দ্রুত সেনা ও বিপ্লবী গার্ডের কমান্ডার এবং শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের শনাক্ত করে হামলা চালিয়েছে।
সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির জন্য এখন সবচেয়ে বড় কাজ হলো— ভেতরের অনুগত্যহীনতাকে চিহ্নিত ও নির্মূল করা।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ছবি: সিএনএন
জার্মানির আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন অতিথি গবেষক হামিদরেজা আজিজি বলেন “নিশ্চয়ই এক ধরনের বিশুদ্ধিকরণ ঘটবে। কিন্তু সেটা করবে কে? সেটাই প্রশ্ন।’’
“বর্তমানে যে ধরনের অবিশ্বাস বিরাজ করছে, তাতে পরিকল্পনা বা নিরাপত্তার পুনর্গঠন কার্যত অচল হয়ে পড়বে।”
এই পরিস্থিতিতে ইরানের সামরিক বাহিনী, বিশেষত বিপ্লবী গার্ডকে পুনর্গঠন করাই হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে বাহিনীর মধ্যস্তরে এখনো দক্ষ কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ রয়ে গেছে। যুদ্ধ থেকে বেঁচে যাওয়া জেনারেল এসমাইল কায়ানি; যিনি গার্ডের কুদস ফোর্সের প্রধান। তেহরানে সরকার-সমর্থিত একটি মিছিলে তিনি উপস্থিত ছিলেন। যদিও আগে দাবি করা হয়েছিল ইসরায়েল তাকে হত্যা করেছে।
সিভিল প্রশাসনে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি কার্যত প্রধানমন্ত্রীর মতো ভূমিকা পালন করেছেন। তিনিই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন, যখন তেহরানের অন্যরা নীরব ছিলেন।
গত দুই দশকে তিনি যে নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলেছেন, তা নিয়ে খামেনিকে পুনরায় ভাবতে হবে। এক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ অক্ষ নীতির মাধ্যমে ইরান তার প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল এবং একইসঙ্গে এটি এক ধরনের প্রতিরক্ষামূলক বাধা হিসেবে কাজ করত, যাতে যুদ্ধ ইরানের সীমান্তে না পৌঁছায়। কিন্তু এই কৌশল এখন ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।
পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতি আরও সংকল্পবদ্ধ হবে ইরান?
ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে ইরানের দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়ার পর খামেনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে, একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রই দেশকে রক্ষা করতে পারবে। যেমনটি উত্তর কোরিয়া করেছে।
ইরান সব সময় দাবি করে এসেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। তবে এটি একমাত্র অ-পারমাণবিক দেশ যারা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে, যা সামরিক অস্ত্রের উপযোগী মাত্রার খুব কাছাকাছি।
বিশ্লেষক আজিজি বলেন, অনেক পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন, এতদিন খামেনি পারমাণবিক অস্ত্রের পথে না যাওয়ার পক্ষে ছিলেন যুদ্ধ এড়াতে। “কিন্তু এখন সেই ধারণার পরিবর্তনের সম্ভাবনা প্রবল,” তিনি বলেন।
আজিজি বলেন, এখন ইরারনের ভেতরে পারমাণবিক বোমা তৈরির দাবিতে সুর আরও জোরালো হচ্ছে।
তবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উদ্যোগ বড় একটি ঝুঁকি হবে। মার্কিন ও ইসরায়েলি হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো স্পষ্ট নয়, তবে নিশ্চিতভাবেই ইরানকে তার পারমাণবিক স্থাপনা ও সেন্ট্রিফিউজ অবকাঠামো পুনর্গঠন করতে হবে, যা কয়েক মাস বা বছর সময় নিতে পারে।
এবং এসব কাজ করতে হবে চরম গোপনীয়তার সঙ্গে ইসরায়েল ও মার্কিন গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে। যদি ইসরায়েল খবর পায়, তাহলে তারা আবার হামলা চালাতে পারে। খামেনি বিকল্প পথও বেছে নিতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ফিরে যেতে পারেন, যাতে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়।
ট্রাম্প প্রসাশানের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে ইরানের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই কথা বলছি। আমরা আশা করি, একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চুক্তি হতে পারে যা ইরানকে পুনরুজ্জীবিত করবে।”
দেশের ভেতরের সংকট
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এই যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সরকার বিরোধী মত দমন আরও তীব্র হবে। ইরানের অর্থনীতি বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, দুর্নীতি ও দুর্বল প্রশাসনের কারণে বিধ্বস্ত।
গত কয়েক মাস ধরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভয়াবহ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং চলছে। যুদ্ধের সময় তেহরানের বহু মানুষ শহর ছেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎতের ওপর চাপ কমেছিল। এখন তারা ফিরলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা।
যুদ্ধের সময় তেহরানের শেয়ারবাজার ও মানি এক্সচেঞ্জ বন্ধ ছিল, যার ফলে ইরানের রিয়ালের পতন সাময়িকভাবে থেমেছিল। ২০১৫ সালে যখন ইরান বিশ্বশক্তির সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করেছিল, তখন প্রতি ডলারের বিপরীতে রিয়ালের মান ছিল ৩২ হাজার। এখন তা প্রায় ১০ লাখ রিয়াল।

ইরানের সংসদ। ছবি: সিএনসিন
দেশটিতে ব্যবসা ও লেনদেন পুরোদমে শুরু হলে আবার পতন শুরু হতে পারে। অর্থনৈতিক সংকট আগেও গণবিক্ষোভ ডেকে এনেছে। ২০১৯ সালে সরকার যখন গ্যাসোলিনের দাম বাড়ায়, তখন ১০০ শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, গ্যাস স্টেশন ও ব্যাংক জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, সেই দমনপীড়নে অন্তত ৩২১ জন নিহত হন এবং হাজার হাজার মানুষ আটক হন।
২০২২ সালে মাসা আমিনির মৃত্যুর পর নারী অধিকারের দাবিতে বিশাল আন্দোলন হয় ইরানে। মাসা আমিনি হিজাব যথাযথভাবে না পরার অভিযোগে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হন এবং পরে মারা যান। সেই দমনপীড়নে ৫০০ জনের বেশি নিহত হন এবং ২২ হাজারের বেশি গ্রেফতার হন।
আজও বহু নারী তেহরানে হিজাব পরতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। কিন্তু অধিকারকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নতুন করে দমনপীড়ন শুরু হতে পারে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নার্গিস মোহাম্মদি গত সপ্তাহে একটি খোলা চিঠিতে লিখেছেন,
“ইসলামি প্রজাতন্ত্র একটি ধর্মীয়, কর্তৃত্ববাদী এবং নারীবিদ্বেষী সরকার—যা সংস্কার-অযোগ্য এবং ধারাবাহিকভাবে ইরানি জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে।”
তবু তিনি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে বলেন, “কারণ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, গণতন্ত্র ও শান্তি যুদ্ধ ও সহিংসতার অন্ধকার পথ থেকে আসবে না।”
খামেনির উত্তরসূরি নিয়ে প্রশ্ন
ইসরায়েল তাকে হত্যার কথা বললেও খামেনি এই যুদ্ধ টিকে গেছেন। কিন্তু তার পরে কে আসবেন? তা এখনো অজানা। ইসারয়েলের সঙ্গে এই যুদ্ধ ইরানের কাঠামোই বদলে দিতে পারে, যেখানে ভবিষ্যৎ সরকার আরও সামরিক ঘরানার হতে পারে।
বর্তমান কাঠামোতে শিয়া আলেমরা সবচেয়ে উচ্চ পদে অবস্থান করেন, যেখানে সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী তাদের অধীন। খামেনি এই কাঠামোর প্রতীক।
একটি শিয়া আলেমদের প্যানেল নতুন সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করবে এবং সম্ভাব্যদের মধ্যে রয়েছেন খামেনির ছেলে ও আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেনির নাতি। এদের মধ্যে কেউ কেউ কঠোরপন্থি আবার কেউ সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত। তবে যেই আসুন না কেন, বিপ্লবী গার্ড ও সামরিক বাহিনীই ইরানের মূল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
আজিজি বলেন, “অনেকে বলাবলি করতেন যে ইরান আলেম-নিয়ন্ত্রিত সরকার থেকে এখন সামরিক-নিয়ন্ত্রিত সরকারের দিকে যাচ্ছে। এই যুদ্ধ সেই সম্ভাবনাকে আরও বাস্তব করেছে… পরবর্তী সরকার আরও সামরিক ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক হবে।”
সূত্র: এপি