রংপুর: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহিদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদ হত্যাকাণ্ডের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া চার্জশিট ভিত্তিহীন ও মনগড়া বলে আখ্যা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
তারা বলছেন, এমন একটি স্পর্শকাতর মামলায় গণশুনানি কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ছাড়াই প্রসিকিউশনের যে চার্জশিট জমা দিয়েছে সেটি, যা ঘটনার পরিণতিতে আংশিক দায়ী হলেও মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতাদের দায়মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে পুলিশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। তাই এই চার্জশীট প্রত্যাখ্যান করে পুনঃতদন্তের দাবি জানিয়েছে তারা।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদ ফটকের সামনে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে এসব অভিযোগ জানানো হয়। উপস্থিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পক্ষে ব্রিফিং করেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সোহাগ।
তিনি লিখিত বক্তব্যে উপস্থাপন করে বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি যৌক্তিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকালে পুলিশের বর্বর গুলিবর্ষণের শিকার হন। ওই ঘটনায় আমাদের প্রিয় সহযোদ্ধা আবু সাঈদ শহিদ হন এবং শতাধিক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। এই নির্মম পুলিশি হামলার চিত্র শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণ নয়, সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘এই বর্বর ঘটনার পর স্বৈরাচারী সরকারের পতনের প্রেক্ষিতে শহিদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বাদী হয়ে এবং আমরা আন্দোলনের সহযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষী হয়ে একটি মামলা দায়ের করি। শুরুতে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর ওপর। তবে, পরে তদন্তের গতিশীলতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ট্রাইব্যুনাল তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণের পর আমাদের কাছ থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ করে এবং আমরা নিজেরা প্রমাণাদি ও তথ্য স্বপ্রণোদিত হয়ে সরবরাহ করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আয়োজিত প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনে তারা পরিকল্পিতভাবে পুলিশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে তারা এমন কিছু ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে উপস্থাপন করছে, যারা ঘটনার পরিণতিতে আংশিক দায়ী হলেও মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতাদের দায়মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে।’
শাহরিয়ার সোহাগ আরও বলেন, ‘আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি তদন্ত প্রতিবেদনে ৩০ জন ব্যক্তির সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেছে। তবে পূর্বের ধারাবাহিকতায় এবারও তারা কোনো পুলিশ সদস্যের নাম উল্লেখ করেননি। বরং একটি প্রশাসনিক অবহেলার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলামকে অভিযুক্ত করেছেন, যা আমাদের কাছে প্রক্রিয়াগত বিচ্যুতি ও প্রহসনের শামিল। এ ছাড়াও, ২৩ জুন নির্ধারিত গণশুনানির পূর্ব ঘোষণা থাকলেও ট্রাইব্যুনালের একটি বিশেষ দল রংপুরে না এসে অজ্ঞাত কারণে সেই গণশুনানি বাতিল করে এবং তড়িঘড়ি করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যায়। এই আচরণ তদন্তের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শাহরিয়ার সোহাগ বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল যেন প্রকৃত দায়ীদের-বিশেষত যাদের নির্দেশে এই গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে—তাদের আইনের আওতায় এনে প্রকৃত বিচারের প্রতিফলন নিশ্চিত করেন। একইসঙ্গে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজকে আহ্বান জানাই, তারা যেন এই বিচার প্রক্রিয়ার যথাযথ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।’
এর আগে দুপুরে সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে উপস্থিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘সাবেক প্রক্টর শরীফুল ইসলামকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে, যদিও তিনি সেই সময় আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মূল অপরাধীদের আড়াল করতেই এই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকত আলী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কী বলেছে, সে বিষয়ে আমি এখনো জানি না। তবে চার্জশিট দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলাটা জরুরি ছিল বলে আমি মনে করি।’