ঢাকা: বেশকিছু সংশোধনী এনে ‘ভোটার তালিকা আইন-২০০৯’-এর নতুন খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রস্তাবিত সংশোধনীর নাম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ভোটার তালিকা (সংশোধিত) অধ্যাদেশ-২০২৫’। ফলে ৪৩ লাখ তরুণ আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, খসড়াটি ভেটিংয়ের জন্য বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে কমিশন। নিয়ম অনুযায়ী এর পর উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন সাপেক্ষে অধ্যাদেশ আকারে জারি হবে। আর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ গঠনের পর সংসদে অধ্যাদেশটি বিল আকারে পাস হলে আইনে রূপান্তর হবে।
এই সংশোধনীর ফলে গৎবাঁধা কোনো নিয়মের মধ্যে আটকে থাকবে না ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম। আগামী বছর থেকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) তাদের সুবিধা মতো সময়ে হালনাগাদ কর্মসূচি শুরু করতে পারবে। এবং খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশও করতে পারবে।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিবছর ২ জানুয়ারি খসড়া ভোটার তালিকা এবং ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশে বর্তমানে যে নিয়ম রয়েছে তাও বহাল থাকবে। এর সঙ্গে নতুন বিধান যুক্ত করা হচ্ছে- জানুয়ারি মাসের পহেলা তারিখ শব্দগুলোর পর, অথবা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক যৌক্তিক বিবেচনায় ঘোষিত অন্য কোনো তারিখ শব্দগুলো সংযোজন করা হয়েছে।
জানা গেছে, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী চলতি বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের শুরুর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। বিদ্যমান আইনের কারণে চলমান হালনাগাদ কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া তরুণ নাগরিকরা ভোট দিতে পারতেন না। এই সংশোধনী পাস হলে সংসদ নির্বাচনের আগে যাদের বয়স ১৮ বছর হবে তারা ভোট দিতে পারবেন। এমনকি তফসিল ঘোষণার আগের দিন পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ বছর তারা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
এ বিষয়ে সদ্য ১৮ পার করা তরুণ ইলতিমাস খান সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি এবার ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে তার নাম যুক্ত করেছেন। ক’দিন পরই তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে পাবেন। তাই এবার আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন বলে বেশ উচ্ছসিত তিনি। এর আগে বাসার সবাই ভোট দিলেও তিনি এবার প্রথমবারের মতো ভোট দিতে পারবেন।
এদিকে এখনো ১৮ পার না হওয়া জান্নাতুল হাফসা সারাবাংলাকে জানান, তিনি শঙ্কায় আছেন। কারণ, এখনো তার ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি। তাই তিনি ভাবছেন এবার আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন কি না। তবে নতুন অধ্যাদশ অনুযায়ী হাফসার বয়স যদি তফসিল ঘোষণার আগেই ১৮ বছর হয় তবে তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন। তাই, নির্বাচন কমিশনের এ ধরণের পদক্ষেপ তরুণ প্রজন্মের জন্য অনেক বেশি আশাব্যঞ্জক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদ্যমান আইন পরিবর্তন ছাড়া আগামী নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মদের ভোট প্রয়োগের সুযোগ ছিল না। তাই কমিশনের ইচ্ছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতা যেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে কোনোভাবেই যেন বঞ্চিত না হয়। এ জন্য ভোটার তালিকা আইনে সংশোধনী আনা হচ্ছে। এটি কার্যকর হলে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম কোনো গৎবাঁধা নিয়মের মধ্যে থাকবে না। যা পরবর্তী কমিশন ও তরুণ ভোটার উভয়ের জন্য সুবিধা হবে।’
জানা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন অগ্রিম ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করে। চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদে গত ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৮ লাখ ৮৯ হাজার ৮৬৬ জন নতুন ভোটার নিবন্ধন হয়েছে, যা বিদ্যমান ভোটারের প্রায় ৫ শতাংশ। নতুনদের সিংহভাগই তরুণ। তাদের মধ্যে ৪৩ লাখ ২৭ হাজারই বাদ পড়া ভোটার। তাদের জন্ম ২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি বা তারও আগে এবং তারা সবাই ১৮ বছরের বেশি বয়সী। অর্থাৎ, ভোটার হওয়ার যোগ্য। বাকিদের বয়স আগামী বছরের ১ জানুয়ারি ১৮ বছর পূর্ণ হবে। তালিকায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভোটার যুক্ত হচ্ছেন। একইভাবে ২১ লাখ ৭ হাজার মৃত ভোটারের তথ্য সংগ্রহ করেছে ইসি।
সূত্র জানায়, ভোটার তালিকা আইনের ৩-এর দফা ‘জ এবং ১১(১) ধারায় সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে ইসির এ সংক্রান্ত কমিটি। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ধারা-৩ এর উপধারা (জ) জানুয়ারি মাসের পহেলা তারিখ শব্দগুলোর পর অথবা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক যৌক্তিক বিবেচনায় ঘোষিত অন্য কোনো তারিখ শব্দগুলো সংযোজিত করা হয়েছে।’ একইভাবে ধারা ১১-এর ৩(১)-এ যা কিছুই থাকুক না কেন, কমিশন যেকোনো সময় যৌক্তিক বিবেচনায় উপধারা ৩(জ) ও ৭(১) এর বিধান সাপেক্ষে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে পারবে, যা তফসিল ঘোষণার পূর্বে সম্পন্ন করতে পারবে’ শব্দগুলা যুক্তের সুপারিশ করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মো. আবদুল আলীম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের রক্তের বিনিময়ে আজকের এই নতুন বাংলাদেশ। তাই নতুন এই দেশ গঠনে তরুণদের অংশগ্রহণ যত বাড়ানো যায় তত ভালো। সেজন্য নির্বাচন কমিশন সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
তিনি জানান, এই সিদ্ধান্তের ফলে তরুণরা ভোটার হয়েই ভোট দিতে পারবে, এতে ভোটের প্রতি তরুণদের আগ্রহ আরো বাড়বে। সেইসঙ্গে এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ সারাবাংলাকে আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ভোটার দিবস পালন করে থাকে। এজন্য সচেতনতামূলক কাজ আরও বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যত বেশি সচেতনতা বাড়বে তত বেশি ভোটার হওয়ার প্রবণতা বাড়বে। মানুষ সময়মতো ভোটার হবে।
এদিকে বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম চলছে, যা শেষ হবে ৩০ জুন। এই ভোটার তালিকা হালনাগাদের পর বর্তমান ভোটার তালিকায় তরুণ ভোটারের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা নির্বাচন কমিশনের।
উল্লেখ্য, ইসির তথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশে ১২ কোটি ৩৭ লাখ ভোটার রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ তরুণ ভোটার, যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৯ বছর। যারা নতুন প্রতিনিধি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।