Friday 27 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন
গণঅভ্যুত্থানের একবছর: বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় বিজয়’ কি ম্লান হওয়ার পথে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৭ জুন ২০২৫ ২০:৩৩ | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৫ ২১:১৬

জুলাই গণঅভ্যুত্থান।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে সপ্তাহখানেক পর। ওই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি সামনে রেখে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট। সারাবাংলার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যে উচ্ছ্বাস এসেছিল, সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে মাত্র চার বছরেই তা ফিকে হয়ে যায়। গত বছর একটি গণবিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশে দ্বিতীয় যে মুক্তির সূচনা হয়েছে, তা আরও দ্রুত ‘ম্লান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে’। ২০২৪ সালের আগস্টে একটি ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে গত ১৫ বছর ধরে ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়। তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল দেশের গণতন্ত্রকে নতুন করে গড়ে তোলা। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও, নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত।

বিজ্ঞাপন

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কঠিন যাত্রা

স্বীকার করতেই হবে ড. ইউনূস এবং তার তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনকে এক অত্যন্ত কঠিন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলা অপশাসনে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে সময় দুর্নীতি ছিল ব্যাপক। সরকারের বিরোধীতা করলে সন্ত্রাসীরা মারধর করত। দারুণ প্রবৃদ্ধির একটি সময়ের পর অর্থনীতি গতি হারিয়েছিল, দেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ যুবক বেকার ছিল। কিছু ক্ষুব্ধ বিপ্লবী শেখ হাসিনার শাসনকে যারা সাহায্য করেছিল বলে মনে করত, তাদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল।

নতুন সরকার কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখিয়েছে। তারা প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থনীতি মন্থর হলেও স্থিতিশীল। মুদ্রাস্ফীতি কমেছে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করছে।

বৈদেশিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক টানাপোড়েন

তবে সরকারের আরও কিছু পদক্ষেপ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকছে, যা বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সস্তা অস্ত্রের সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রফতনির বৃহত্তম ক্রেতা এবং একসময় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাতা ছিল (ট্রাম্প প্রশাসনের সহায়তা কমানোর আগ পর্যন্ত)। চীনের দিকে এই ঝোঁক, এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বর্ধিত ঘনিষ্ঠতা ভারতেরও বিরক্তির কারণ হয়েছে। গত গ্রীষ্ম পর্যন্ত বাংলাদেশের এই বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকলেও, এখন তা ভেঙে যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারত একটি ট্রান্স-শিপমেন্ট চুক্তি বাতিল করেছে যা বাংলাদেশি সংস্থাগুলোর জন্য লাভজনক ছিল। এ ছাড়া তারা বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফেরত পাঠিয়েছে। এখন তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী-বণ্টন চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা করতে চাইছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিতর্কিত পদক্ষেপ

ড. ইউনূসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুন করে সাজানো। এর অর্থ হলো দেশের কলহপ্রিয় দলগুলোকে নির্বাচনের নতুন নিয়ম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত করানো। কিন্তু চলমান পরিস্থিতি থেকে ‍বুঝা যাচ্ছে, রাজনীতিবিদরা এই প্রক্রিয়ায় ধৈর্য হারাচ্ছেন। রাজনৈতিক মতবিরোধ স্পষ্ট হচ্ছে। জুনের মাঝামাঝি সময়ে একদল জনতা একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনারকে আক্রমণ করে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে কারচুপি করতে সাহায্য করেছিলেন।

মে মাসে অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন একটি বড় ভুল পদক্ষেপ নেয়। তারা আওয়ামী লীগের কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলত দলটি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিচার শুরু করেছে আদালত। যা তারা সঠিকভাবেই করছেন। তবে এতদিন যে আশা ছিল- আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে নতুন করে ফিরে আসার আন্দলোন গড়ে তুলবে সে সুযোগ হারিয়েছে তারা।

একটি সন্ত্রাস-বিরোধী আইনের সংশোধনের মাধ্যমে জারি করা এই নিষেধাজ্ঞা আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এটি বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের দীর্ঘদিনের পুরোনো নোংরা কৌশলগুলোর মতোই মনে হচ্ছে, যা দিয়ে তারা বিরোধীদের দমন করে। এটি বাংলাদেশকে প্রতিশোধের এক চক্রে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে, যেখানে যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তার ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করা হয়।

বাংলাদেশের নেতাদের উচিত আওয়ামী লীগের ওপর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং তাদের একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া। অনেক নাগরিকের কাছে এটি হয়তো অপ্রীতিকর মনে হতে পারে– তবে বাংলাদেশের প্রাচীনতম এই দলের সবাই কলঙ্কিত নন। দলটি এখনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোসহ উল্লেখযোগ্য সমর্থন ধরে রেখেছে। বছরের পর বছর ধরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর, এই ভোটারদের তাদের পছন্দের কাউকে ভোট দেওয়ার অধিকার থাকা উচিত।

আওয়ামী লীগ অবাধে প্রচারণার সুযোগ পেলেও হয়তো নির্বাচনে জিতবে না। তবে সংসদে তাদের উপস্থিতি বিরোধী দলকে শক্তিশালী করতে পারে, যা বিজয়ীদের সজাগ রাখতে সাহায্য করবে। একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে পুনর্মিলন প্রয়োজন, প্রতিশোধ নয়।

সারাবাংলা/এইচআই

গণঅভ্যুত্থান ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্য ইকোনমিস্ট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর