Monday 21 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আর কোনোদিন মা বলে ডাকবে না’


১ জুলাই ২০১৮ ১৬:০৮

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে: ‘ছেলেটা তখন মাস্টার্সে পড়ে। একদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেলিম আল দীন বাড়িতে আসলেন। আমাকে বললেন, আপনার ছেলে একদিন এমন দরজায় পা রাখবে যে পুরো বিশ্ব জানবে। ছেলেটা একটা দরজায় পা রাখছে ঠিকই, কিন্তু সেই দরজা পার হয়ে আর আমার কাছে আসবে না। আর কোনোদিন মা বলে ডাকবে না।’

আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগের এই দিনে গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহত হন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার রবিউল করিম। ছেলেকে হারিয়ে বুকে চেপে রাখা কষ্টের কথাগুলো এভাবেই সারাবাংলা’কে বলছিলেন রবিউলের মা করিমন নেছা।

শুক্রবার (২৯ জুন) মানিকগঞ্জের কাটিগ্রাম এলাকায় রবিউল করিমের গ্রামের বাড়িতে কথা হয় তার মা করিমন নেছা ও স্ত্রী উম্মে সালমার সঙ্গে। করিমন নেছা কাঁদেন আর কথা বলেন। তার কাছে সন্তানকে হারিয়ে বেঁচে থাকা বুকে পাথর বয়ে বেড়ানোর সমান।

করিমন নেছা বলেন, ‘২০১৬ সালের ১ জুলাই তিন বার কথা হয় ছেলের সাথে। দুপুরে ফোন করে বলে, আমার সাথে ইফতার করবে। কতকিছু রান্না করলাম, ছেলেটা আসবে। অপেক্ষা অপেক্ষা করতে করতে ইফতারির আগ মুহূর্তে ফোন করি। জিজ্ঞাসা করি, বাবা কত দূর? বাবা আমার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, মা আমি অফিসে, আসতে পারলাম না। মোবাইলটা রেখে শুধু ইফতার করলাম। রান্না করা খাবার বক্স করে রেখে দিলাম ফ্রিজে। কিন্তু সেটাই যে শেষ মা ডাকা ছিল, বুঝতে পারিনি।’

করিমন নেছা বলতে থাকেন, ‘সেদিন রাতে ছেলের শ্বাশুড়ি ফোন করে। কী বলেছিলেন, মনে নেই। দরজা খুলে বের হলাম, কান্নাকাটি শুনলাম। আর কিছু মনে নেই আমার। দেখতে দেখতে দুইটা বছর চলে গেছে! ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতেই পারি না, আমার কামরুল নাই। যার সন্তান চলে গিয়েছে, সে মা’ই শুধু জানে এই কষ্টটা কেমন।’

বিজ্ঞাপন

 

ঘটনার দিন সন্ধ্যাতেই ঘুমের জন্য শুয়ে পড়েন রবিউলের ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামস। তিনি বলেন, ‘থাকি সাভাবে, ১২টার পর ঘুমাই, টিভি দেখি। কিন্তু সেদিন টিভিও দেখিনি, শুয়ে পড়ি ঘুমানোর জন্য। আমাদের অভিভাবক চাচা ফোন করেন সাড়ে ১০টার দিকে। প্রথমে তার ফোনও ধরিনি। পরে দেখি অনেকবার ফোন করেছেন। ব্যাক করলাম, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে মিথ্যা বললাম। চাচা বললেন টিভি দেখতে। টিভি খুলতেই দেখি স্ক্রল যাচ্ছে- গুলশানে হামলায় রবিউল করিম গুরুতর আহত। এখানে-ওখানে ফোন দিলাম, সব শুনে গেলাম ইউনাইটেডে। কিন্তু গিয়ে আর ভাইকে পেলাম না।’

জঙ্গিবাদ নিয়ে কিছু বলার আছে কিনা জানতে চাইলে করিমন নেছা বলেন, কারো সন্তানকে যেন বাবাহারা না হতে হয়, কোনো মাকে যেন সন্তানহারা না হতে হয়, কোনো স্ত্রীকে যেন স্বামীহারা না হতে হয়। কোনো মা যেন সন্তানকে হারিয়ে এমন ধুঁকে ধুঁকে না বেঁচে থাকে, সরকার যেন এমন ব্যবস্থা নেন- এটাই আবেদন এক সন্তানহারা মায়ের। আমার আর কিছু বলার নেই।

রবিউলের মা বলেন, সেদিন ছেলের মুখটা দুইবার দেখেছি। যখন প্রথম আনলো, আর যখন নিয়ে গেল। কিন্তু এখন মনে হয়, কেন আমি ছেলের পাশে বসে থেকে আরেকটু মন ভরে দেখলাম না। আমার ছেলের মুখটা যে আর দেখতে পাব না- সেটা তো আমি তখনও বুঝিনি, সেই চেতনাই আমার ছিল না।

পুলিশের পোশাক পরা রবিউল করিমের ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগে ড্রেস বানিয়ে এনে মাথার ‍টুপি আমার হাতে দিয়ে সালাম করে বলেছিল, মা আমাকে পরিয়ে দাও। আমি পরিয়ে দিয়েছিলাম। যদি জানতাম, সন্তান চলে যাবে, তাহলে আমি নিষেধ করতাম।

পুরো বাড়িজুড়ে রবিউলের লাগানো গাছ। কামরুন নেছা বলেন, ‘কত গাছ লাগিয়ে গিয়েছে। সেই গাছে এখন কত ফল ধরে। পাখিতে খায়, মানুষকে দিয়ে দেই। গাছগুলোকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরি, গাছের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু গাছেরা তো আর মা বলে ডাকে না, গলা জড়িয়ে ধরে না।’ বলতে বলতে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

নিজেকে সামলানোর সময় নেন। বলতে থাকেন, ‘ওর ব্যাচমেটরা আসে। অনেক আন্তরিকতা নিয়ে ওরা আমার কাছে এসে বসে, কথা বলে। তারা বলে, আপনার এক রবিউল গিয়েছে, আমরা আপনার শত শত রবিউলরা রয়েছি। সেটা ঠিক আছে, কিন্তু সন্তান হারানোর কী কষ্ট! ওরা তো আমাকে আন্টি বলে, কেউ খালাম্মা বলে, কেউ তো আমাকে আর মা বলে না।’

বলেই কোলে থাকা রবিউলের ছবির ওপর হাত বোলান করিমন নেছা, ছেলের মুখে চুমু খান, ছবিটাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন।

রবিউলের মৃত্যুর ঠিক একমাস পর জন্ম হয় তার মেয়ে কামরুন্নাহার রায়নার। সেই মেয়ে বাবার ছবিতে আদর করে। ‘ছেলেটা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। কারও আদর সহ্য করতে পারত না, বাবাকে খুব মিস করে ছেলেটা’, বলেন রবিউল করিমের স্ত্রী উম্মে সালমা। তিনি বলেন, ‘স্ত্রী হিসেবে আমি গর্বিত ছিলাম স্বামীকে নিয়ে। এখনও গর্বিত। তবে শুধু আমার ছেলে-মেয়ে তার বাবাকে কাছে পায় না। ছেলের বন্ধুদের বাবারা যখন তাদের সন্তানদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন ছেলের কষ্টটা দেখা যায় না।’

ফেরার পথে রবিউলের মা ও স্ত্রীর শেষ কথা, সবাই দোয়া করবেন যেন রবিউল জান্নাতবাসী হয়, তার আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়; আর এই দেশ যেন জঙ্গিমুক্ত হয়।

সারাবাংলা/জেএ/জেএএম

আরও পড়ুন-

বিভীষিকাময় রাতের ২ বছর

নতুন ‍ঠিকানায় হলি আর্টিজান,কাটেনি অস্বস্তি!

বাংলা‌দে‌শে জঙ্গিরা এখন আর সক্রিয় নেই: কা‌দের

‘শোককে শক্তিতে পরিণত করেই জঙ্গি নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিয়েছি’

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর