Saturday 28 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যুদ্ধ যখন তুচ্ছ কারণে: ইতিহাসের কিছু বিস্ময়কর সংঘাত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৮ জুন ২০২৫ ১৯:৪০ | আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫ ২১:০৩

শিল্পীর তুলির আঁচড়ে যুদ্ধরত সৈনিকেরা। ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর ইতিহাসে অগণিত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এসব যুদ্ধের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা, এবং মতাদর্শগত সংঘাত। এছাড়াও, সীমান্ত বিরোধ এবং দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা ও সংঘাত প্রায়শই যুদ্ধ ডেকে এনেছে। এমনকি, ভয় ও অবিশ্বাস বাড়তে বাড়তে পরিস্থিতিকে ভয়াবহ যুদ্ধের দিকেও ঠেলে দিয়েছে।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, কখনো কখনো তুচ্ছ ঘটনা থেকেও ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এসব যুদ্ধের পরিণতি হয় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং অগণিত প্রাণহানি।

সারাবাংলার পাঠকদের জন্য তুচ্ছ ঘটনা থেকে শুরু হওয়া কয়েকটি যুদ্ধের খবর নিচে দেওয়া হলো—

বিজ্ঞাপন

বালতির যুদ্ধ :

১৩২৫ সালের ১৫ নভেম্বর ইতালির দুটি শহর বোলোগনা এবং মডেনার মধ্যে সংঘটিত হয়েছে বালতির যুদ্ধ। কূপ থেকে একটি কাঠের বালতি চুরি করে নিয়ে যায়কে কেন্দ্র করে যুদ্ধ শুরু হয়। মোডেনার সৈন্যরা প্রতিপক্ষ বোলোগনা শহরের একটি কূপ থেকে একটি কাঠের বালতি চুরি করে নিয়ে যায়। তুচ্ছ ঘটনাটি দুই শহরের মধ্যে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুনে ঘি ঢালে। এতে বাঁধে যুদ্ধ। মাত্র একদিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রায় ২০০০ মানুষ মারা যায়। এই যুদ্ধে মোডেনা জয়ী হয়।

শূকর যুদ্ধ:

১৮৫৯ সালের ১৫ জুন ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকা (বর্তমানে কানাডার অংশ) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে ভয়াবহ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল তা ইতিহাসে শূকরের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

একজন আমেরিকান কৃষক লাইম্যান কাটলার তার আলুখেতে একটি ব্রিটিশ মালিকানাধীন শূকরকে ঘুরতে দেখে গুলি করে হত্যা করেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। উভয় পক্ষই সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে।

শূকর হত্যার পর উভয় পক্ষই সান জুয়ান দ্বীপে সৈন্য পাঠায়, যা একটি সামরিক অচলাবস্থার সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ এবং আমেরিকান উভয় পক্ষই নিজেদের অবস্থান ধরে রাখে, কিন্তু সরাসরি কোনো সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি। পরে উভয় দেশের সরকার বুঝতে পারে যে একটি শূকরের জন্য একটি বড় যুদ্ধ শুরু করা হাস্যকর, অপ্রয়োজনীয়। তাই তারা কূটনৈতিক সমাধানের পথে হাঁটে।

১৩ বছর পর ১৮৭২ সালে চূড়ান্তভাবে আন্তর্জাতিক সালিশির মাধ্যমে এ যুদ্ধের সমাধান হয়। শূকরকে গুলি করার ঘটনায় ব্রিটিশ ও আমেরিকান সৈন্যদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লেও কোনো বড় ধরনের সশস্ত্র সংঘাত ঘটেনি। হয়নি রক্তপাত।

প্যাস্ট্রি যুদ্ধ:

১৮৩৮ সালে মেক্সিকো এবং ফ্রান্সের মধ্যে সংঘটিত হয় প্যাস্ট্রি যুদ্ধ। ফরাসি প্যাস্ট্রি শেফ রেমন্টেল দাবি করেন যে ১৮২৮ সালের দাঙ্গায় জনতার হাতে তার দোকানের ক্ষতি হয়েছে। তিনি ক্ষতিপূরণের দাবি জানান। মেক্সিকো সরকার তার ক্ষতিপূরণ না দেওয়ায় ঘটনায় ফ্রান্সের রাজা লুই-ফিলিপ হস্তক্ষেপ করে মেক্সিকোর কাছে বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। এই নিয়ে প্যাস্ট্রি যুদ্ধ শুরু হয়।

প্রায় পাঁচ মাস স্থায়ী হয়েছিল প্যাস্ট্রি যুদ্ধ। এটি ১৮৩৮ সালের নভেম্বর মাসে শুরু হয়ে ১৮৩৯ সালের ৯ মার্চ ব্রিটিশ-মধ্যস্থতা করা শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এর অবসান ঘটে। যুদ্ধে ফরাসি পক্ষে প্রায় ১২১ জন ও মেক্সিকান পক্ষে প্রায় ২২৪ জন নিহত বা আহত হয়েছিল। প্যাস্ট্রি যুদ্ধে ফ্রান্স জয়ী হয়েছিল।

আরও পড়ুন:

জাঞ্জিবার যুদ্ধ: ৩৮ মিনিটের সংঘাতে ৫০০ হতাহত

ফুটবল যুদ্ধ:

১৯৬৯ সালে সালভাদর ও হন্ডুরাসের মধ্যে একটি ফুটবল বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচকে কেন্দ্র করে যে সংঘাত শুরু হয়েছিল, তা ইতিহাসে ফুটবল যুদ্ধ নামে পরিচিত। ম্যাচগুলো এতটাই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল যে উভয় দেশের সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।

এই ফুটবল ম্যাচগুলো শেষ হওয়ার পরপরই এল সালভাদর হন্ডুরাস আক্রমণ করে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে প্রায় ২০০০ এর বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। তবে, এই সংঘাতের মূলে ছিল দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ, অবৈধ অভিবাসন এবং ভূমি সংক্রান্ত জটিল সমস্যাগুলি।

যুদ্ধ চার দিনের মতো স্থায়ী হয়েছে।এটি ১৯৬৯ সালের ১৪ জুলাই শুরু হয়ে ১৮ জুলাই শেষ হয়। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চেষ্টায় যুদ্ধের অবসান ঘটে। যদিও মূল সমস্যাগুলোর সমাধান হতে আরও অনেক সময় লেগেছিল।

ফুটবল যুদ্ধে কেউই চূড়ান্ত বিজয়ী হয়নি। এটি ছিল একটি সংক্ষিপ্ত অথচ রক্তক্ষয়ী সংঘাত। যার ফলে উভয় দেশই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল।

জেনকিন্সের কানের যুদ্ধ:

জেনকিন্সের কানের যুদ্ধ ছিল গ্রেট ব্রিটেন (ইংল্যান্ড) এবং স্পেনের মধ্যে সংঘটিত একটি যুদ্ধ। যা ১৭৩৯ সাল থেকে ১৭৪৮ সাল পর্যন্ত চলেছিল।

এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল ১৭৩৮ সালে। সে সময় ব্রিটিশ নাবিক জেনকিন্সকে স্পেনের উপকূলরক্ষীরা জাহাজ থামিয়ে কান কেটে দেয়। এই ঘটনার জের ধরেই যুদ্ধ শুরু হয়। ৯ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে প্রায় ৩৫,০০০ লোক মারা যায়। ব্রিটিশদের প্রায় ৩০,০০০ এবং স্প্যানিশদের প্রায় ৪,৫০০ হতাহত হয়।

দ্য ওয়ার অফ দ্য স্ট্রে ডগ (কুকুরের যুদ্ধ):

কুকুর যুদ্ধ ছিল বুলগেরিয়া এবং গ্রিসের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত সামরিক সংঘাত, যা একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল। এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয় যখন একজন গ্রিক সৈন্যের পোষা একটি কুকুর সীমান্ত অতিক্রম করে বুলগেরিয়ার দিকে চলে যায়। কুকুরটিকে ফিরিয়ে আনার জন্য ওই গ্রিক সৈন্য যখন সীমান্ত পার হয়, তখন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

কুকুর যুদ্ধ ছিল একটি অত্যন্ত স্বল্পকালীন সংঘাত, যা মাত্র ৬ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়েছিল। ১৯২৫ সালের ১৮ই অক্টোবর শুরু হয়ে এই যুদ্ধ অক্টোবরের শেষ দিকে লিগ অফ নেশনসের হস্তক্ষেপে শেষ হয়। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় ১০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন বুলগেরিয়ার বেসামরিক নাগরিক। গ্রিক সেনারা বুলগেরিয়ার ভূখণ্ডে প্রবেশ করে কিছু গ্রামে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বেশি ছিল।

এই সামান্য ঘটনাটি দুটি দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সীমান্ত উত্তেজনা সামরিক সংঘাতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে, জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপে এই সংঘাতের অবসান ঘটে। গ্রীসকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়।

সারাবাংলা/এসআর

জেনকিন্সের কানের যুদ্ধ দ্য ওয়ার অফ দ্য স্ট্রে ডগ প্যাস্ট্রি যুদ্ধ ফুটবল যুদ্ধ বালতির যুদ্ধ শূকর যুদ্ধ