কাতার (দোহা) থেকে: কাতারে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশি আম উৎসবে সুমিষ্ট ও বাহারি জাতের আমের চাহিদায় মুগ্ধ দেশীয় উদ্যোক্তা ও বিক্রেতারা। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বিক্রি ও আমের সংকটের কারণে একদিন আগেই শেষ হয়েছে মেলা। ছয় দিনে এই আম উৎসবে আম বিক্রি হয়েছে ৭৩ টন। আর এ সময়ে মেলায় এসেছেন অর্ধ লাখেরও বেশি দর্শনার্থী। আমের সংকট ও কাতারে ঘটে যাওয়া মিসাইল হামলার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মধ্যেও প্রায় পুরোটাই সফল হয়েছে এই মেলা।
সোমবার (৩০) কাতারের রাজধানী দোহার বাণিজ্য এলাকাখ্যাত সুক ওয়াকিফে অনুষ্ঠিত সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশি ম্যাংগো ফেস্টিভ্যাল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
দোহায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের আয়োজনে গেল ২৫ জুন শুরু হওয়া এই মেলা ১ জুলাই পর্যন্ত চলার কথা থাকলেও আমের সংকটে একদিন আগে শেষ হওয়া এই মেলার অনুষ্ঠানিক সমাপনী অনুষ্ঠিত হবে আজ মঙ্গলবার (১ জুলাই) বিকেলে। কাতার ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই মেলা বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলার কথা ছিল। কিন্তু সোমবার তারও ঘণ্টা খানেক আগে মেলায় বিদায়ের সুর বেজে ওঠে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ষষ্ঠ দিনে রাত ৭টার দিকে মেলায় উপচে পড়া ভিড়। মেলা শেষ হওয়ায় ঘণ্টা খানেক আগেই সবগুলো স্টলের আম শেষ হয়ে যায়। বেশিরভাগ স্টলের আম শেষ হয়ে যাওয়ায় সন্ধ্যার দিকেই মেলা বন্ধের ঘোষণা আসে।
মেলা ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার মেলার ষষ্ঠ দিনে কাতার সময় সন্ধ্যা ৬টা থেকেই আম শেষ হতে শুরু করে। রাত ৮টায় প্রায় অধিকাংশ স্টলে আম শেষ হয়ে যায়। আর রাত সাড়ে ৮টায় একটি স্টলেও আম দেখা যায়নি। এদিন, ১৮ থেকে ২০ রিয়ালে (১ রিয়াল প্রায় ৩৪ টাকা) প্রতি কেজি আম বিক্রি হয়েছে।

ছবি: সারাবাংলা
উদ্যোক্তারা জানান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) এর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্দোলনে কাস্টমসেও শাটডাউন কর্মসূচি পালিত হওয়ায় বিমানে করে আম আনতে পারেননি অনেক আমদানিকারও। এছাড়া ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের সময় গেল ২৩ জুন কাতারে ইরানের মিসাইল হামলার কারণে আকাশপথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো আমের প্রথম চালানের অর্ধেকের বেশি আম কাতারে প্রবেশ করতে পারেনি। এই দুই কারণে কাতারে অনুষ্ঠিত আম মেলায় আমের সংকট দেখা দেয়। আর গেল রোববার থেকেই মেলায় আম সংকটের আভাস পাওয়া যায়।
স্থানীয় সময় সোমবার রাতে মেলা ঘুরে দেখা যায়, আম কিনতে না পেরে অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন। যে স্টলে কিছুটা আম রয়েছে সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্রেতারা। অন্যদিকে আম বিক্রি হয়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ স্টল ফাঁকা পড়ে রয়েছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কথা হলে জেনিথ ফ্রুটস এন্ড ভেজিটেবল স্টলে কর্মরত রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, সব স্টলে আম শেষ হয়ে যাওয়ায় আমাদের স্টলে চাপ পড়েছে। আর মাত্র কয়েক মিনিট আম বিক্রি করতে পারব। আমরা যে আম এনেছিলাম তা দিয়ে মঙ্গলবারও স্টল চালানো যেত। কিন্তু সব ক্রেতা এখানে হুমড়ি খাওয়ায় আম কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
ইন্ডিগো করপোরেশণের স্টল ম্যানেজার সানজিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আম শেষ। বেশিরভাগ দোকানে আম শেষ হয়ে যাওয়ায় মেলা কর্তৃপক্ষ একদিন আগেই মেলা বন্ধ করে দিচ্ছে। আজকেই মেলার শেষ দিন। ৬ দিনে আমরা প্রায় ৯ টন আম বিক্রি করেছি।’
মেলায় কথা হয় সিলেট জেলার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম সঙ্গে। তিনি দোহার আল আসমায় বসবাস করেন। সোমবার মেলা প্রাঙ্গণে কথা হলে সাইফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, মেলায় আম নিয়ে আমরা ভালোই রেসপন্স দেখছি। মেলাটি অনেক সাড়া ফেলেছে। এই মেলার মাধ্যমে বাংলাদেশের রফতানিও বাড়বে। কিন্তু আম শেষ হয়ে যাওয়ায় একদিন বাকি থাকতেই আজ মেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে আগামীতেও মেলার এই ধারা যাতে অব্যাহত থাকে সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।
মেলায় দেখা গেছে বেশ কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করছেন। বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে সমন্বয় করে মেলার সার্বিক দেখভাল করছেন তারা। কাতার বাংলাদেশি কমিউনিটি ভলান্টিয়ার গ্রুপের ম্যানেজার সৈয়দ আসিফ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেলা সফল হয়েছে। আমরা যতোটুকু প্রত্যাশা করেছিলাম তারচেয়েও বেশি সফল হয়েছে এই মেলা। কমিউনিটি ভলান্টিয়ার গ্রুপের আশা ছিল, বাংলাদেশের বাগান থেকে সরাসরি আসা আম, প্রতিটি কাতারের অধিবাসীদের খাওয়াব, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। স্থানীয় কাতারের বাসিন্দা ও অন্য দেশের প্রবাসীরা এই আম খেয়ে বলেছেন, এর থেকে মিষ্টি আম আর আগে কখনো খাইনি। এটি একটি বিরাট বড় অর্জন।’

ছবি: সারাবাংলা
বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব আব্দুল্লাহ আল রাজী সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশ ম্যাংগো ফেস্টিভ্যাল নির্ধারিত দিনের একদিন আগেই সোমবার শেষ হয়েছে। কারণ সবগুলো স্টলের আম বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। যেহেতু আমগুলো বাংলাদেশ থেকে আসে ও একদিনের মধ্যে নতুন করে কোনো আম আনা সম্ভব নয়, ফলে সর্বসম্মতিক্রমে একদিন আগেই মেলা শেষ করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, গত ২৩ তারিখের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যসহ সকল দেশের ফ্লাইট শিডিউল চেঞ্জ হয়ে যায়। আমাদের লক্ষ্য ছিলো ১২০ টনের মতো বিক্রি হবে। প্রথম ফ্লাইটেই বিশাল অংকের আম আসার কথা ছিলো। সেই আমগুলো বিমানবন্দরে ছিলো। কিন্তু ওই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে অর্ধেকের মতো দেশে ব্যাক করে। প্রতিবন্ধকতা থাকলেও আমরা মনে করি, একদিন আগেও মেলা শেষ হলেও মেলাটি সফল। গত কয়েকদিনে ৭০ থেকে ৭৫ টনের মতো আম বিক্রি হয়েছে। মেলা চালিয়ে যেতে পারলে বিক্রি ১০০ টন ছাড়িয়ে যেতে পারতো।
এদিকে, কাতারের সুক ওয়াকিফ কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, আম মেলার প্রথম দিনে ৮ হাজার ৭০০ কেজি আম বিক্রি হয়েছে। সেদিন মেলায় দর্শনার্থী আসে ৭ হাজার জন। দ্বিতীয় দিনে ১১ হাজার ৩০০ কেজি আম বিক্রি হয়েছে। সেদিন মেলায় দর্শনার্থী আসে ১২ হাজার ২০০ জন। তৃতীয় দিনে মেলায় আম বিক্রির পরিমাণ ৯ হাজার ৭০০ কেজি ও দর্শনার্থী এসেছিলেন ১২ হাজার ৫০০ জন। চতুর্থ দিনে আম বিক্রি হয়েছে ২১ হাজার ৫০০ কেজি ও সেদিন মেলায় দর্শনার্থী ছিলেন ১৪ হাজার ৪০০ জন। পঞ্চম দিনে মেলায় আম বিক্রির পরিমাণ ১৭ হাজার ৭৮০ কেজি ও দর্শনার্থী ১০ হাজার। মেলার পাঁচ দিনে ৬৮ হাজার ৭৩০ (৬৮ টন)। পাঁচ দিনে মেলাহ দর্শনার্থী এসেছেন ৫৫ হাজার ৭০০ জন। রাতে মেলার আয়োজক কাতার কর্তৃপক্ষ জানায়, ষষ্ঠ দিনে মেলায় ৪ হাজার ২০০ কেজি আম বিক্রি হয়েছে। ফলে ছয় দিনে মেলায় ৭২ হাজার ৯৩০ কেজি অর্থাৎ প্রায় ৭৩ টন আম বিক্রি হয়েছে। আর ছয় দিনে মেলায় দর্শনার্থী এসেছেন প্রায় ৬৪ হাজার জন।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশি আমের ঘ্রাণে মেতেছে কাতার