চট্টগ্রাম ব্যুরো: জুলাই বিপ্লবের বছরে টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেও প্রায় ৩৩ লাখ আমদানি-রফতানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার জাহাজে ওঠা-নামা ও সরবরাহ সামাল দিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দর দিয়ে কনটেইনারে পণ্য আনা-নেওয়া শুরুর পর এটাই সর্বোচ্চ রেকর্ড বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যানুযায়ী, সোমবার (৩০ জুন) শেষ হওয়া অর্থবছর ২০২৪-২০২৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি ও রফতানি মিলিয়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭ টিইইউস (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একক হিসেবে)। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছিল। এ হিসেবে একবছরের ব্যবধানে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে ৪ শতাংশেরও বেশি।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার প্রায় মাসব্যাপী গণআন্দোলন, ইন্টারনেট শাটডাউন, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের প্রভাব পড়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক কার্যক্রমে। প্রায় মাসখানেক বন্দরের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার শেষ প্রান্তে ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কারণেও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ধস নামে।
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর দ্রুততার সঙ্গে বন্দরে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম শুরু হয়। তবে এর মধ্যেও দেশের বিভিন্ন জেলায় আকস্মিক বন্যা, দফায় দফায় পণ্য পরিবহণকারী যানবাহন চালক-শ্রমিকদের ধর্মঘট নিয়ে অস্থির পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে বন্দরকে। সর্বশেষ দুই ঈদের টানা দীর্ঘ ছুটি এবং কাস্টমসে কলমবিরতি-কমপ্লিট শাটডাউনের প্রভাব পড়ে বন্দরে।
তবে এরপরও ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে চট্টগ্রাম বন্দর। ১৯৭৭ সাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারে পণ্য নিয়ে জাহাজ আসা শুরু হয়। একইভাবে কনটেইনার রফতানি পণ্য পরিবহণও শুরু হয়। এ হিসেবে গত ৪৮ বছরে এত বিপুল পরিমাণ কনটেইনার পরিবহণের রেকর্ড আর নেই।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে গণঅভ্যুত্থানসহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে অর্থবছরটি শুরু হয়েছিল। শুরুতে প্রায় একমাস ধরে বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল না। এরপরও বিভিন্ন পরিস্থিতি সামলাতে হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরে নানামুখী সংস্কার কার্যক্রম চালানো হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ায় আমদানি-রফতানিতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় বন্দর এ সাফল্য অর্জন করেছে।’
বন্দর কর্মকর্তাদের মতে, নৌপরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেনের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ হওয়ায় কনটেইনার ডেলিভারি দ্রুততর হয়েছে। এ ছাড়া, বন্দরের অটোমেশান সার্ভিস সুবিধা, ই-গেট পাস চালু, কনটেইনার অপারেটিং সিস্টেম আধুনিকায়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নেরও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
উল্লেখ্য, দেশে আমদানি-রফতানিকেন্দ্রিক সমুদ্র বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনার ও পণ্য পরিবহণের ৯৮ শতাংশ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। লয়’ড লিস্ট অনুযায়ী বিশ্বের ১০০টি ব্যস্ততম বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৬৭তম। মূলত কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করেই এই তালিকা করা হয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৭৫ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল। তবে সেই অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে হ্যান্ডলিং কম হয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৬২ শতাংশে। ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল। প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৫ দশমিক ১১ শতাংশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০ লাখ ৯৭ হাজার ২৩৬ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল। প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ১০ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০ লাখ ৪ হাজার ১৪২ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল। প্রবৃদ্ধি হয় ২ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ২৯ লাখ ১৯ হাজার ২৩ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল। প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ২৮ লাখ ৯ হাজার ৩৫৪ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ।
বন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে কনটেইনারবিহীন বাল্ক জাহাজে খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে ১৩ কোটি ৭ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৩ মেট্রিকটন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছিল ১২ কোটি ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৭৪৮ মেট্রিক টন। কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এ ছাড়া, বিদায়ী বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ এসেছে ৪ হাজার ৭৭টি। গতবছর এসেছিল ৩ হাজার ৯৭১টি।