চট্টগ্রাম ব্যুরো: আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সন্ত্রাসীদের হামলায় চট্টগ্রামে দুই শিক্ষার্থী নিহতের অভিযোগে আলাদা দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাউছার মাহমুদ ও আরেকজন মাদরাসা ছাত্র নিজাম উদ্দিন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিহতের মামলায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ ৯১ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ২০০ থেকে ২৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা হিসেবে আসামি করা হয়েছে। মাদরাসা ছাত্র নিহতের মামলায় হাছান মাহমুদ-নওফেলসহ ৩৫ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ১০০ থেকে ১৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
ঘটনার প্রায় একবছর পর মঙ্গলবার (১ জুলাই) দুই শিক্ষার্থীর বাবা নগরীর কোতোয়ালি থানায় আলাদাভাবে মামলা দুটি দায়ের করেন।
নিহত কাউছার মাহমুদ (২২) নগরীর ডবলমুরিং থানার মোগলটুলি এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আব্দুল মোতালেবের ছেলে। কাউছার চট্টগ্রামের বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির বিবিএ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
নিজাম উদ্দিন (২১) নগরীর কোতোয়ালি থানার খলিফাপট্টি এলাকার মো. সুরুজ মিয়ার ছেলে। নিজাম নগরীর বাকলিয়ার শান্তিনগর এলাকায় একটি মাদরাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র ছিলেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আবদুল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দুই ছাত্র নিহতের ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। একটিতে ৯১ জন এবং আরেকটিতে ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। আমরা তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’
উভয় মামলার আসামির তালিকায় থাকা একাধিক সাবেক মন্ত্রী-সংসদ সদস্যসহ অধিকাংশই চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতাকর্মী।
কাউছারের বাবার দায়ের করা মামলার আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারি, মহিউদ্দীন বাচ্চু ও আবদুচ ছালাম, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও রেজাউল করিম চৌধুরী, সাবেক কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব, শৈবাল দাশ সুমন, জহরলাল হাজারী, এসরারুল হক, নুর মোস্তফা টিনু, জোবায়ের, বাহাদুর, আব্দুল কাদের ওরফে মাছ কাদের, জিয়াউল হক সুমন, গিয়াস উদ্দিন, সলিমুল্লাহ বাচ্চু, আশরাফুল আলম, শহীদুল আলম ও আব্দুস সবুর লিটন।
ওই মামলায় সরকারি সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুদীপা দত্ত, সাবেক সাংসদ ফজলে করিমের ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, নগর আওয়ামী লীগ নেতা আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, মানস রক্ষিত, চন্দন ধর, মশিউর রহমান, দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম, সাবেক যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি, নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবু ও সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান, নগর যুবলীগের সভাপতি মাহমুদুল হক সুমন ও সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম দিদারও আসামির তালিকায় আছেন।
মামলার এজাহারে দেখা গেছে, আসামির তালিকায় আছেন নগর আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক দেবাশীষ গুহ বুলবুল ও সদস্য অমল মিত্র। কিন্তু বুলবুল ২০২১ সালের ৫ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অমল মিত্র মারা গেছেন ২০২৩ সালের ৭ মার্চ।
এ ছাড়া, মামলায় আসামির তালিকায় সাবেক কাউন্সিলর জহরলাল হাজারীর নাম তিনবার এবং গিয়াস উদ্দিন, মশিউর রহমান, দিদারুল আলম মাসুম, আজিজুর রহমান আজিজ, নুরুল আজিম রনি, ইমরান আহমেদ ইমু ও জাকারিয়া দস্তগীরের নাম দুইবার করে উল্লেখ আছে।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ৪ আগস্ট দুপুরে নগরীর নিউমার্কেট মোড়ে কাউছার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হন। ১৩ অক্টোবর ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
এদিকে নিজামের বাবার দায়ের করা মামলায়ও হাছান মাহমুদ, নওফেল, ফজলে করিম ও তার ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরী, আ জ ম নাছির, জহরলাল হাজারী, শৈবাল দাশ সুমন, নুরুল আজিম রনি, জাকারিয়া দস্তগীরসহ ৩৫ আসামির নাম আছে, যাদের অধিকাংশই আগের মামলায়ও আসামি।
ওই মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট দুপুরে নগরীর লালদিঘীর পাড়ে ছাত্র-জনতার সমাবেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এক বছর পর মামলা দায়েরের বিষয়ে উভয় মামলার বাদী এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ‘উক্ত ঘটনার বিস্তারিত অবগত হইয়া আমার পরিবার এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সহিত আলোচনা করিয়া এজাহার দায়ের করিতে বিলম্ব হয়।’