ঢাকা: ২০২৪ সালের ২ জুলাই, মঙ্গলবার। কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাই আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন। এদিন রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিতভাবে। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিবাদ গড়ে তোলে তারা।
শাহবাগ অবরোধ: প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু
২ জুলাই দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে শুরু হয় দিনের মিছিল। এর পর শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও বাটা সিগন্যাল মোড় ঘুরে শাহবাগে গিয়ে অবস্থান নেয়। বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত তারা শাহবাগ চত্বরে অবস্থান নিলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় তাদের কণ্ঠে শোনা যায়: ‘No Quota, Only Merit’ ‘Reinstate the 2018 Circular’ ‘মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙিয়ে দুর্নীতি শেষ হোক’। শাহবাগে শুধু অবরোধ নয়, এটি হয়ে উঠেছিল ‘মুক্ত চত্বর’— যেখানে ইতিহাস, অধিকার ও গণতন্ত্রের কথা একসঙ্গে উচ্চারিত হয়।
সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদ
এদিন বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী হঠাৎ করেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে নেমে আসে। তারা প্রায় ২০ মিনিট সড়ক অবরোধ করে রাখেন। এটি সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি হলেও বার্তা ছিল দৃপ্ত। ‘এই আন্দোলন শুধুই ঢাকার নয়, সারা দেশের ছাত্রসমাজের।’ জাহাঙ্গীরনরের আন্দোলন ছিল খুবই কৌশলী ও প্রভাবশালী। কারণ, এটি দেখিয়ে দেয় আন্দোলন শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ নয়, সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
২ জুলাই দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরেও শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কুমিল্লায় আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রামে শহিদ মিনার চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মশাল মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। এগুলো কোনো এলোমেলো প্রতিবাদ ছিল না। এটি ছিল একটি সমন্বিত প্রতিরোধ, যেখানে ‘শিক্ষা’, ‘ন্যায়’ ও ‘গণতন্ত্র’ শব্দগুলো নতুন করে সংজ্ঞায়িত হচ্ছিল।
আন্দোলনের পটভূমি ছিল ২০১৮
২ জুলাইয়ের আন্দোলনের পেছনে ছিল ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের রক্তমাখা স্মৃতি। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা কোটার যৌক্তিক সংস্কার চাওয়া হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা বাতিল করা হয়নি। বরং, ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ের মাধ্যমে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটার পুনর্বহাল হয়। এই রায়ের প্রতিবাদেই শুরু হয় আন্দোলনের দ্বিতীয় ঢেউ। শিক্ষার্থীরা বলেন— ‘আমরা স্বাধীনতা চাই, কিন্তু সুযোগের নামে বৈষম্য নয়।’
তথ্য দমন ও ডিজিটাল নিপীড়নের আশঙ্কা
যদিও ২ জুলাই থেকেই সামাজিক মাধ্যমে নজরদারি, গুজবের ভয় এবং সরকারপক্ষীয় ‘মিথ্যা প্রচারণা’র ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। সরকারের একাধিক মন্ত্রী তখনো বলেছিলেন, ‘এটি বিএনপি-জামায়াতের প্ররোচণা।’ কিন্তু গ্রাউন্ড রিপোর্ট বলছে, অংশগ্রহণকারী অধিকাংশই ছিলেন ছাত্র ও চাকরিপ্রার্থী— যাদের একমাত্র পরিচয় ‘শিক্ষার্থী’।
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন ২ জুলাই নিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, “একবছর আগে ফিরে তাকালে মনে হয় ওই দিনটি ছিল গণঅভ্যুত্থানের সূচনালগ্ন। যে অভ্যুত্থান ছিল ‘কোটার নামে বৈষম্য নয়, মেধার জন্য সমান সুযোগ’- এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী। এই আন্দোলনের ঢেউ যে সরকার, প্রশাসন, এমনকি বিচার ব্যবস্থাকেও নাড়িয়ে দেবে, তা তখনও দেশবাসী বুঝে উঠতে পারেনি। আমরা কনফিডেন্টলি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম ঠিকই। কিন্তু, আমাদের কাছেও স্পষ্ট ছিল না যে, আমরা কতটা সফল হব।’
মনিরা শারমিন বলেন, ‘আন্দোলনের ধারাবাহিকতা থেকে কেউই আমরা সরে আসতে চাইনি। আমরা খুব বেশি জ্বালাময়ী ছিলাম না তখনো। কিন্তু রাজপথে ছিলাম। কারণ, রাজপথ থেকে সরে গেলেই হয়তো দাবির প্রশ্নটা পিছিয়ে পড়তে পারে, সেই আশঙ্কা ছাত্রদের মধ্যে ছিল। তাই আমরা চেষ্টা ২ জুলাইয়ের দিন সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি করেছিলাম। ১ ঘণ্টার একটা মিছিল করেছিলাম শুধু।’
তিনি আরও বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চলছিল। আর আমরা ভাগে ভাগে বিভিন্নভাবে তখনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম যে, প্রথম পদক্ষেপে সরকার রাজি না হলে আমাদের দ্বিতীয় পদক্ষেপ কী হতে পারে। এবং সেদিন রাতেই আমরা প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেই যে, ৩ জুলাইও আমরা সংক্ষিপ্ত কর্মসূচির মধ্যেই থাকব। এর পর আমরা ৩ জুলাইয়ের অপেক্ষায় থাকলাম। ভাবতে থাকলাম যে, পরদিন আমরা কতদূর কী করতে পারব। আর সরকার কী করবে সেই অপেক্ষায় রইলাম…।’