Friday 04 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বৈরী আবহাওয়ায় সাগর অচল, দুর্বিষহ জেলেদের জীবন

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৪ জুলাই ২০২৫ ২০:৪১

বৈরী আবহাওয়ায় ট্রলারগুলো বেঁধে রাখা হয়েছে।

কক্সবাজার: দীর্ঘ ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগর উন্মুক্ত হলেও কক্সবাজারের জেলেদের জীবনে স্বস্তি ফেরেনি। বৈরী আবহাওয়ার কারণে মাছ শিকারে যেতে না পারায় লক্ষাধিক জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ট্রলার মালিক ও মাছ ব্যবসায়ীরাও। স্থানীয় বাজারে দেখা দিয়েছে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছের সংকট। এই পরিস্থিতির জন্য মাছ ব্যবসায়ীরা সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময়কালকে দায়ী করছেন। তবে মৎস্য কর্মকর্তারা আশার কথা শোনাচ্ছেন।

মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত মোট ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর জেলেরা সাগরে মাছ শিকারে যাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছিলেন। ট্রলার ভর্তি ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশসহ নানা প্রজাতির মাছ নিয়ে ঘাটে ফেরার স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা। ট্রলার মালিক ও ব্যবসায়ীরাও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে তাদের সব প্রস্তুতি যেন ভেস্তে গেছে।

বিজ্ঞাপন

আবহাওয়া অফিসের সতর্কবার্তার নির্দেশনায় অধিকাংশ মাছ ধরার ট্রলার নিরাপদ স্থানে নোঙর করে রাখা হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে অল্প কিছু ট্রলার স্বল্প দূরত্বে মাছ শিকারে গেলেও, ইলিশের মূল বিচরণ ক্ষেত্র ৭০-৮০ কিলোমিটার দূরের গভীর সাগরে যেতে পারছেন না জেলেরা। এর মধ্যেই গত ২০ দিনের ব্যবধানে মহেশখালী ও বাঁকখালী পয়েন্টে তিনটি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটেছে, যা জেলেদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

সাগরে মাছ শিকারে যেতে না পারায় নিবন্ধিত ৬৫ হাজার জেলের পাশাপাশি লক্ষাধিক জেলে এখন বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। এতে ট্রলার মালিক ও মাছ ব্যবসায়ীরাও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। স্থানীয় বাজারেও ইলিশসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছেরসংকট দেখা দিয়েছে, যার ফলে ভোক্তাদেরও উচ্চমূল্যে মাছ কিনতে হচ্ছে।

এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেরা সঠিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সরকারের জরুরি সহায়তা কামনা করছেন। তারা মনে করছেন, দ্রুত সরকারি সহায়তা না পেলে তাদের জীবনযাপন আরও কঠিন হয়ে পড়বে এবং মৎস্য খাতের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সমিতিপাড়ার জেলে জাফর আলম তার হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘গেল ৫৮ দিনের বন্ধের সময় এমনিতেই অনেক কষ্টে ছিলাম। ভেবেছিলাম সমুদ্র খুললে সব কষ্ট কেটে যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সাগর খোলা থাকলেও সতর্কবার্তার কারণে যেতে পারছি না। কষ্ট যেন কোনোভাবেই পিছু ছাড়ছে না।’

মাছ ধরার ট্রলার।

একইভাবে জেলে শফিকুর রহমান বলেন, ‘এখন নিষেধাজ্ঞা খুলে দেওয়া আর না দেওয়া সমান। কারণ, আবহাওয়ার এই খারাপ অবস্থায় চাইলেও সাগরে মাছ শিকারে যাওয়া যাচ্ছে না। আমরা বরাবরই বেকার হয়ে পড়েছি। এই অবস্থায় সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।’

ট্রলার মালিক লিয়াকত হোসেন জানান, তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এবং বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা ধার করে গভীর সাগরে ট্রলার পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু যেই মুহূর্তে সাগর উন্মুক্ত করা হলো, ঠিক তখনই শুরু হলো বৈরী আবহাওয়া। তিনি বলেন, ‘এটি খুবই দুঃখজনক। শুধু আমি নই, এই ভোগান্তিতে পড়েছেন আরও অনেক ট্রলার মালিক।’

মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধিতে জেলেদের প্রস্তাবনায় সর্বসম্মতিক্রমে ৬৫ দিনের পরিবর্তে ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে মাছ ব্যবসায়ীরা এই নিষেধাজ্ঞার সময় নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তারা সরকারের কাছে নিষেধাজ্ঞার সময় পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন, যাতে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যাহত না হয়।

মৎস্য ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ‘সরকার যদি এই নিষেধাজ্ঞা আরও আগে দিত, তাহলে এমন ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। বৈরী আবহাওয়ার কারণে গভীর সাগরে যেতে না পারায় পল্টনে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ নেই বললেই চলে। যা অল্প মাছ উঠছে, তাও ঝুঁকি নিয়ে অল্প দূরত্বে যাওয়া ট্রলারের ছোট মাছ।’

আরেক ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ইলিশসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছে ভরপুর থাকত। স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাছ রফতানি করা হতো। কিন্তু এবার বৈরী আবহাওয়ার কারণে পল্টনের চিত্র সম্পূর্ণ পালটে গেছে। লইট্টাসহ ছোট প্রজাতির কিছু মাছ ছাড়া বড় মাছ নেই বললেই চলে।’

শহরের বড় বাজার, বাহারছড়া বাজার এবং কালুর দোকানসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশসহ বড় প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের দেখা নেই বললেই চলে। যা সামান্য পরিমাণ মাছ পাওয়া যাচ্ছে, তা কেবল অল্প দূরত্বের ট্রলারে ধরা পড়া ছোট প্রজাতির মাছ। এই সংকটের কারণে মাছের দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, যা সাধারণ ক্রেতাদের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়েছে।

কক্সবাজারের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার সুজয় পাল এই পরিস্থিতি নিয়ে বিচলিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির জন্য ৭-৮ মাস পর্যন্ত মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও জেলে, মৎস্য গবেষক ও সংশ্লিষ্টদের প্রস্তাবনার ভিত্তিতেই আগের ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞাকে ৫৮ দিনে কমিয়ে আনা হয়েছে।

তিনি সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করে বলেন, ‘বৈরী আবহাওয়া শেষ হলেই জেলেরা আবারও মাছ শিকারে যেতে পারবে। সুতরাং এ নিয়ে এত বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।’ তিনি আরও আশ্বস্ত করেন, জেলেদের সহায়তায় সরকার সব সময় তাদের পাশে আছে।

জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে, গত বছর ইলিশসহ জেলেদের জালে ২ লাখ ৪৯ হাজার মেট্রিক টন মাছ ধরা পড়েছিল। কিন্তু এই বছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এদিকে, আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতি আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকতে পারে, যা জেলে এবং মৎস্য ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে।

সারাবাংলা/এইচআই

কক্সবাজার জেলে ট্রলার মালিক বৈরী আবহাওয়া মাছ ব্যবসায়ী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর