কুমিল্লা: কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কড়ইবাড়ি গ্রামে একটি মোবাইল ফোন চুরিকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। জনরোষের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন একই পরিবারের মা, ছেলে ও মেয়ে। এ ঘটনায় আরেক মেয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং একটি চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনা কীভাবে এত বড় হত্যাকাণ্ডে রূপ নিল, সেই মর্মান্তিক কাহিনিই উঠে এসেছে নিহতদের পরিবার ও প্রতিবেশীদের বক্তব্যে।
নিহতরা হলেন— রুবি বেগম (৫৮), তার ছেলে রাসেল (৩৫) ও মেয়ে জোনাকি আক্তার (২৭)। রোকসানা আক্তার রুবির আরেক মেয়ে রুমা আক্তার (৩০) গণপিটুনির শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
কড়ইবাড়ী গ্রামের মানুষের অভিযোগ, নিহত রোকসানার পরিবার দুই দশকের বেশি সময় ধরে মাদক কারবারে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে থানায় মাদক-সংক্রান্ত একাধিক মামলা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের ওপর এলাকাবাসীর ক্ষোভ ছিল। মঙ্গলবার (১ জুলাই) মোবাইল ফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় একটি পক্ষ নতুন করে এই পরিবারের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীকে ক্ষেপিয়ে তুলে।
মঙ্গলবার বিকেলে স্থানীয় শিক্ষক রুহুল আমিনের একটি মোবাইল ফোন চুরি হয়। চোর সন্দেহ করা হয় রুবির মেয়ের জামাই মনির হোসেনকে। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকালে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বাচ্চু মিয়া এবং আকাবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ওই বাড়িতে যান। রুবিকে ফোন ছিনতাই বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন। এতে রুবি ক্ষেপে গিয়ে তাদের ওপর উলটো হামলা করেন বলে অভিযোগ করেন চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য। চেয়ারম্যান এবং ইউপি সদস্য দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
জানা যায়, শিমুল বিল্লাল আকুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
আরেক পক্ষের অভিযোগ, বোরহান উদ্দিন ওরফে মারুফ নামের এক তরুণ ফোনটি চুরি করেন। এই তরুণ রুবির মেয়ে জোনাকির স্বামী মনির হোসেনের সঙ্গে কাজ করেন। তার বাড়ি উপজেলার হায়দরাবাদ এলাকায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, রুবির খুচরা মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেন বোরহান।
শিক্ষকের মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগ এনে মঙ্গলবার আকাবপুর ইউপির ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বাচ্চু মিয়া ও স্থানীয় বাছির উদ্দিনের নেতৃত্বে বোরহানকে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে বোরহানকে ছাড়িয়ে নিতে যান রুবি। সেখানে বাচ্চু-বাছিরসহ অন্যদের সঙ্গে রুবি ও তার পক্ষের লোকজনের বাগ্বিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। এ ঘটনাকে ঘিরে পরদিন বুধবারও দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এসব নিয়ে দুই পক্ষে উত্তেজনা চলছিল।
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে কড়ইবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আসেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ও ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া। এ সময় তাদের সঙ্গে রুবি ও তার মেয়েদের বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ইউপি সদস্য বাচ্চুকে চড় দেন রুবি। এর পরই রুবির বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা ইউনুছ মিয়াসহ আরও অনেকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান রুবির বাড়ি থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর এলাকার মসজিদের মাইকে চেয়ারম্যান ও মেম্বারের ওপর হামলার কথা জানিয়ে লোকজন জমায়েত করা হয়। প্রায় দেড় হাজার লোক লাঠিসোটা নিয়ে রুবির বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এ সময় রুবি ও তার মেয়েকে পিটিয়ে হত্যা করে মরদেহ বাড়ির সামনে ফেলে রাখে। অন্য একটি গ্রুপ বাড়ির অদূরে রাস্তায় রুবির ছেলে রাসেলকে পিটিয়ে হত্যা করে। এ সময় গুরুতর আহত হন রুবির আর এক মেয়ে রুমা।
খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে রুমাকে উদ্ধার করে সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করে। এ সময় একটি কক্ষে লুকিয়ে থেকে রক্ষা পান রুবির স্বামী জুয়েল ও নিহত রাসেলের স্ত্রী মিনি আক্তার।
মিনি আক্তার বলেন, ‘একই এলাকার শরীফ, বাছির, রফিক, রবিউল আউয়াল ও জিলানীর নেতৃত্বে কয়েকশ লোক বাড়িতে হামলা চালায়। সন্তানদের নিয়ে তিনি একটি কক্ষে আশ্রয় নেন। পরে র্যাব এসে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এলাকার কয়েকশ লোক ঘটনাস্থলে সমবেত। বাড়ির সামনে পড়ে ছিল তিনজনের মরদেহ। পাশাপাশি তিনটি ভবনের প্রতিটিতে হামলা ও ভাঙচুরের চিহ্ন দেখা গেছে।
উপস্থিত লোকজন জানায়, মাইকে চেয়ারম্যান-মেম্বারের ওপর হামলার খবর পেয়ে কড়ইবাড়ী, পীরকাসিমপুর, মেটাংঘর, হিরাকাসিসহ আশপাশের লোকজন দ্রুত ঘটনাস্থলে আসে।
আকাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল বলেন, ‘মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের একটি ঘটনা নিয়ে আমি ও ইউপি মেম্বার বাচ্চু জিজ্ঞেস করতে গেলে আমাদের ওপর প্রথমে হামলা চালায়। সম্মান বাঁচাতে স্থান ত্যাগ করি। পরে গ্রামবাসী খবর পেয়ে ওই বাড়িতে গিয়ে হামলা চালায়। এ সময় আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। পরে জানতে পেরেছি, রুবি, তার ছেলে এবং মেয়ে নিহত হন। তবে এমন হত্যাকাণ্ড কোনোভাবে কাম্য নয়।’
বাঙ্গরা বাজার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘গণপিটুনিতে তিনজন ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছেন। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে আহত রুমা আক্তার ও পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করেছে। কয়েক গ্রামের লোক এ হামলায় জড়িত। নিহতের পরিবার উদ্যোগ না নিলে পুলিশ মামলা করবে।’
কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান বলেন, ‘যাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তারা অপরাধী হয়ে থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে পারত। কিন্তু আইন হাতে তুলে নিয়ে যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তদন্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’