ঢাকা: আজ রোববার (৬ জুলাই) মহরমের দশ তারিখ, পবিত্র আশুরা। ৬১ হিজরি সালের এই দিনে হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার পরিবারের সদস্যরা ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে কারবালার ময়দানে শহিদ হন। পবিত্র আশুরা তাই মুসলিম উম্মাহর জন্য এক তাৎপর্যময় ও মর্মস্পর্শী বিয়োগাত্মক-শোকাবহ দিন। দিনটি মুসলমানদের কাছে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠারও দিন। এ দিনটি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে খুবই প্রিয়। তাই তিনি এ দিনে রোজা পালনের সওয়াব প্রদান করে থাকেন বহুগুণে।
আশুরার রোজার উৎপত্তি:
ইসলামে আশুরার রোজার উৎপত্তি হযরত মুসা (আ.)-এর বিজয়ের সাথে সম্পর্কিত। যখন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনি দেখতে পান যে ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখে। তাদের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তারা জানায় যে, এই দিনে আল্লাহ তায়ালা নবী মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এই বিজয়ের শুকরিয়াস্বরূপ মুসা (আ.) রোজা রেখেছিলেন এবং ইহুদিরাও তা পালন করত।
তখন মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমরা তোমাদের (ইহুদিদের) চেয়ে মুসা (আ.)-এর প্রতি বেশি হকদার।’ এরপর তিনি সাহাবিদের আশুরার দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দেন। প্রাথমিকভাবে এই রোজা রাখা ওয়াজিব ছিল, তবে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এটি নফল রোজায় পরিণত হয়।
হাদিসে আশুরার রোজা:
হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর প্রিয় মহরম মাসের রোজা এবং ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদ) নামাজ (সহিহ মুসলিম)।
আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশুরার রোজা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো, তিনি বললেন, আমি আশা করি আল্লাহর কাছে এটি বান্দার বিগত এক বছরের গুনাহসমূহের কাফফারা হিসেবে গণ্য হবে (মুসলিম হা/১১৬২; মিশকাত হা/২০৪৪)।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ রোজা ছাড়া অন্য কোনো রোজাকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি। আর তা হলো আশুরার রোজা ও এই রমজান মাসের রোজা (বুখারী ও মুসলিম)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার রোজা পালন করলেন ও অন্যকে পালন করার নির্দেশ দিলেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, এটা তো এমন এক দিন যাকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সম্মান করে থাকে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আগামী বছর আসলে ইনশা-আল্লাহ আমরা নবম তারিখে রোজা পালন করব।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, পরবর্তী বছর আসার আগেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করলেন (মুসলিম)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা আশুরা দিবসে রোজা পালন কর ও এ ক্ষেত্রে ইহুদিদের বিরোধিতা কর। সহিহ বুখারি ও মুসলিমের হাদিস অনুযায়ী পবিত্র আশুরার দিনে মুসা (আ) ও তার সাথিদের মুক্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো ঘটনা প্রমাণিত নয়। এ দিনে মহান আল্লাহ তার রাসূল মুসা (আ.) ও তার সঙ্গী বনী ইসরাইলকে ফিরাউনের হাত থেকে উদ্ধার করেন এবং ফিরাউন ও তার সঙ্গীদের ডুবিয়ে মারেন। পবিত্র আশুরার দিন মুসলিম জাহানের জন্য যে কারণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আলেমদের মতামত :
ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমাদ, ইসহাক এবং আরও অনেক আলেম বলেন, ১০ তারিখে রাসুল (সা.) রোজা রেখেছেন এবং ৯ তারিখ রোজা রাখার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন। তাই উভয় দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব (উত্তম)।
আশুরার রোজার ফজিলত:
আশুরার রোজার বিশেষ ফজিলত সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ আছে। সহিহ মুসলিম শরিফের এক হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আরাফাতের দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তিনি এর দ্বারা পূর্ববর্তী এক বছরের ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। আর আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তিনি এর দ্বারা পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম: ১১৬২)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, আশুরার এক দিনের রোজা এক বছরের গুনাহ মাফ হওয়ার কারণ হতে পারে, যা এর বিশাল ফজিলতের প্রমাণ।
রোজা রাখার বিভিন্ন পদ্ধতি:
ইসলাম আশুরার রোজা পালনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছে, যাতে ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য না হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইহুদিদের থেকে ভিন্নতা প্রকাশের জন্য মহররম মাসের ৯ ও ১০ তারিখ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন।
শুধু ১০ তারিখ রোজা রাখা এটিই ন্যূনতম। ১০ মহররম রোজা রাখতে চান, তবে তাও জায়েজ, তবে উত্তম হলো ৯ তারিখের সঙ্গে মিলিয়ে রোজা রাখা।
৯ ও ১০ তারিখ রোজা রাখা- আশুরার আগের দিন (৯ মহররম) এবং আশুরার দিন (১০ মহররম) উভয় দিন রোজা রাখা। এটি উত্তম ও সুন্নতের অনুসরণ। অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এই পদ্ধতিকে অধিক উত্তম বলেছেন।
১০ ও ১১ মহররম রোজা রাখা– যদি কোনো কারণে ৯ মহররম রোজা রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে ১০ ও ১১ মহররম রোজা রাখা যেতে পারে।
মুহাররমের ৯ ও ১০ তারিখে রোজা রাখা হাদিসের আলোকে প্রমাণিত এবং অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। রাসুল (সা.) নিজে ১০ তারিখ রোজা রেখেছেন এবং ৯ তারিখও রোজা রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তাই মুসলিমদের উচিত এই দুই দিন রোজা রেখে ঐতিহ্য ও ফজিলত রক্ষা করা। তবে ৯ তারিখে রোজা রাখতে না পারলে অনেক আলেম ১০ তারিখের সঙ্গে ১১ তারিখ মিলিয়ে রোজা রাখার পরামর্শ দেন।
আশুরার রোজা শুধু সওয়াবের উদ্দেশ্যে নয়, এটি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং অতীতের নবীদের বিজয়ের স্মারক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি মুসলমানদের মনে আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতা, ধৈর্য এবং শোকের মধ্যেও আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায়ের শিক্ষা দেয়। এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং সত্যকে আঁকড়ে ধরার অনুপ্রেরণাও দেয়।