ঢাকা: নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৩০০ আসনের সীমানার খসড়া প্রকাশ করে থাকে নির্বাচন কমিশন। এই খসড়ার ওপর দাবি-আপত্তি ও শুনানি শেষে চূড়ান্ত সীমানার গেজেট প্রকাশ করা হয়। আগামী বছরের শুরুর দিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ের ঘোষণা আছে সরকারের পক্ষ থেকে। সেই হিসাবে দ্রুতই আসনগুলোর সীমানাসংক্রান্ত জটিলতা সমাধান করা প্রয়োজন। এরই মধ্যে ৭৫টি আসনের সীমানাসংক্রান্ত জটিলতার ৬০৭টির বেশি আবেদন জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো খসড়া প্রকাশ করেনি ইসি।
এদিকে সীমানা নির্ধারণকে বিতর্কমুক্ত রাখতে স্বাধীন একটি কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনেও সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে বিশেষায়িত কমিটি গঠনে সব দল একমত হয়েছে। তবে খসড়া প্রকাশের আগে জমা পড়া এসব আবেদনের নিষ্পত্তি হবে কীভাবে? কবে হবে খসড়া, আর চূড়ান্ত সীমানার গেজেটই বা কবে? এ সবের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন সারাবাংলার এই প্রতিবেদক।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
সীমানা নির্ধারণ নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি কারিগরি কাজ। এটিকে বিতর্কমুক্ত রাখতে বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমরা স্বাধীন একটি সীমানা নির্ধারণ কমিশনের সুপারিশ করেছি। সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনেও সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে বিশেষায়িত কমিটি গঠনের বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে।’
এ জন্য অধ্যাদেশ দ্রুত সংশোধন এবং অধ্যাদেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন যাতে কাজ শুরু করতে পারে সেজন্য বিশেষায়িত কমিটি করে দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘এই দুইটা কাজ করলে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে থাকবে না কোনো জটিলতা। সেইসঙ্গে থাকবে না ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যা বলছে
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল বিশেষায়িত কমিটি গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ।
জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী সমাধানে ঐক্যমত হয়েছে। ঐক্যমতের বিষয়গুলো হলো- প্রতি আদমশুমারির অনধিক ১০ বছর পরে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের জন্য সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের দফা ১ এর ‘গ’ শেষে আইনের দ্বারা একটি বিধান যুক্ত করা। এর অর্থ হচ্ছে সংসদীয় আসন নির্ধারণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা।
এই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সীমানা নির্ধারণের আইন ২০২১, যেটা ২০২৫ সালে সংশোধিত হয়েছে, আমরা সংবিধানে কিছু বিষয় যুক্ত করার কথা বলেছি। পাশাপাশি সেটাকে বাস্তবায়নের জন্য কমিটির পরিধি ও কার্যপরিধি গঠন নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইনের কথা বলেছি।
নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য
এদিকে বিশেষায়িত কমিটির অপেক্ষায় রয়েছে কমিশন। নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কমিশনের আন্ডারে একটি কমিটি; অনেকটাই টেকনিক্যাল কমিটি হবে। এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো রূপরেখা নাই যে, কাকে নিয়ে করতে হবে। সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে পরবর্তী নির্দেশনার জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি।’
এদিকে সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইন নিয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ এরই মধ্যে বলেছেন, ‘সীমানা পুনর্নির্ধারণ আমাদের যে আইন আছে, সেই আইন অনুযায়ী হবে। যেমন আইনে যে জিনিসগুলো আছে- প্রশাসনিক অখণ্ডতা, ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, ভোটার সংখ্যা ও ঐতিহাসিক ভিত্তিও সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হবে।’
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সীমানা নির্ধারণে ইসির পরিবর্তে ‘একটি সীমানা নির্ধারণ কমিশন’ করতে সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ করেছিল। সুপারিশে বলা হয়েছিল, আলাদা কমিশন গঠন না করা পর্যন্ত ইসির সহায়তায় একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠন করা; যেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচন কর্মকর্তা, ভূগোলবিদ, মানচিত্রকার, পরিসংখ্যানবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ, তথ্য প্রযুক্তিবিদ, জনসংখ্যাবিদসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত হবেন। এ কাজে দেশি-বিদেশি যেকোনো ব্যক্তি, সংস্থারও পরামর্শ নিতে পারে ইসি।
এরই মধ্যে সংস্কার কমিশন এ সংক্রান্ত আইনের খসড়াও প্রস্তাব করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা অন্য কোনো নির্বাচন কমিশনারকে প্রধান করে এ বিশেষায়িত কমিটি হবে। সুপারিশে সীমানা নির্ধারণের পদ্ধতি তুলে ধরে বলা হয়, কমিশন বা বিশেষায়িত কমিটি প্রস্তাবিত এলাকা প্রকাশের পর আপত্তি নিয়ে জেলা পর্যায়ে শুনানি নিয়ে চূড়ান্ত তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করবে।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সাবেক সদস্য আব্দুল আলীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সীমানা পুননির্ধারণ টেকনিক্যাল কাজ। সেহেতু টেকনিক্যাল লোকদের সমন্বয়ে একটা বিশেষায়িত কমিটি হবে। যে কমিটি নির্বাচন কমিশনের আন্ডারেই কাজ করবে; ইলেকশন কমিশন ফর্ম করবে।’ এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন উদ্যোগ নেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এখন এই ভিত্তিতে নতুন করে হয়তো অধ্যাদেশ আকারে এটা জারি হবে।’
অধ্যাদেশটি দ্রুত হয়ে গেলে জুলাই-অক্টোবরের মধ্যে বিশেষায়িত কমিটির কাজ শেষ করে দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে নভেম্বরের মধ্যে চূড়ান্তভাবে সীমানার গেজেট প্রকাশ করা সম্ভব বলে মনে করেন এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ।
৭৫ আসনের সীমানা পরিবর্তনে ৬০৭টি আবেদন
ইসি সূত্রে জানা গেছে, সীমানা পরিবর্তন চেয়ে ৭৫টি আসনের জন্য ৬০৭টির আবেদন জমা পড়েছে। সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছে পিরোজপুর-২ আসনে। এই আসনে আবেদন পড়েছে ১০৩টি। আরও জানা গেছে, পিরোজপুর-২ আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনা হলে এর প্রভাবে পিরোজপুর-১ আসনেও পরিবর্তন আসবে। এই আসনে বেশ কয়েকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। যদিও ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন মহারাজের কাছে হেরে যান তিনি। এ ছাড়া, পিরোজপুর-১ আসনের সংসদীয় এলাকার সীমানা পরিবর্তন চেয়ে একটি আবেদন জমা হয়েছে।
ঢাকা-১, ২ ও ৩ এই তিনটি আসনের সীমানায় পরিবর্তন চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে ২৩টি। এর মধ্যে বেশিরভাগ আবেদনে দোহার উপজেলাকে ঢাকা-১ এবং নবাবগঞ্জ উপজেলাকে ঢাকা-২ আসনে পুনর্বহাল করার দাবি করা হয়েছে। ২০০১ সাল ও তার আগেও এই দুটি উপজেলা আলাদা সংসদীয় আসন ছিল।
ঢাকা-৭ আসনের সীমানায় পরিবর্তন চেয়ে ৩৬টি আবেদন জমা পড়েছে। এসব আবেদনকারীর বড় অংশ ঢাকা-২ আসন পুনরুদ্বার করে কামরাঙ্গীরচর থানাধীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডকে ঢাকা-৭ লালবাগ এলাকার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করেছেন। বর্তমানে জিনজিরা, আগানগর, তেঘরিয়া, কেন্ডা ও শুভাঢ্যা ইউনিয়ন বাদে কেরানীগঞ্জ উপজেলা, সাভারের আমিনবাজার, তেঁতুলঝরা ও ভাকুর্তা ইউনিয়ন পরিষদ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা-২ আসন।
এ ছাড়া ঢাকা-৪ আসনে ২টি, ঢাকা-১২ আসনে একটি, ঢাকা-১৬ আসনে একটি, ঢাকা-১৯ আসনে একটি এবং ঢাকা-২০ আসনে একটি করে আবেদন রয়েছে। ২০০৮ সালে ঢাকায় আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ২০টি করা হয়। এ কারণে কয়েকটি জেলার আসন কমেছে।
কুমিল্লা-১, ২, ৬, ৯, ১০ সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন চেয়ে মোট ১০৪টি আবেদন জমা হয়েছে। এসব আবেদনে যেসব পরিবর্তন চাওয়া হয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হলে এ জেলার অন্য কয়েকটি আসনের সীমানাতেও পরিবর্তন আসবে।
মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ ও রাজবাড়ী জেলা থেকে অর্ধশতাধিক আবেদন করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনে। এসব আবেদনে ওই চার জেলায় একটি করে আসন বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আবেদন করা হয়েছে।
অন্য জেলাগুলোর মধ্যে বরিশাল-৪ সংসদীয় আসন থেকে হিজলা উপজেলাকে কর্তন করে বরিশাল-৩ আসনের সঙ্গে যুক্তের জন্য একটি আবেদন পড়েছে। এ ছাড়া রংপুর-১ আসনে একটি, গাইবান্ধা-৩ আসনে একটি, সিরাজগঞ্জ-১ আসনে একটি, সিরাজগঞ্জ-২ আসনে দুটি, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে তিনটি ও সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে ৫টি আবেদন রয়েছে।
এছাড়াও যশোর-২ আসনে একটি, সাতক্ষীরা-৩ আসনে একটি, সাতক্ষীরা-৪ আসনে একটি, বরগুনা-১ ও ২ আসনে ৮টি, ঝালকাঠি-২ আসনে একটি, নেত্রকোনা-৫ আসনে একটি, কিশোরগঞ্জ-২ আসনে একটি, এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রাম জেলার কয়েকটি আসনের সীমানা পরিবর্তন চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে। গাজীপুর-১ আসনে একটি, গাজীপুর-৩ আসনে পাঁচটি, গাজীপুর-৫ আসনে চারটি আবেদন রয়েছে।
উল্লেখ্য, যেসব আসনে আবেদন জমা পড়েনি, সেগুলোর সীমানায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) হাত দেবে না বলে জানা গেছে।