ঢাকা: ৮ জুলাই ২০২৪। ‘কোটা না মেধা, মেধা, মেধা’— স্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছিল রাজধানী ঢাকা। শুধু ঢাকা নয়, দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহর, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর এবং আন্তঃজেলা সড়ক ও রেলপথে গর্জে উঠেছিল একটাই দাবি— সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে।
৬৫ সদস্যের ‘সমন্বয়ক কমিটি’ ঘোষণা
এদিন গঠিত হয় ৬৫ সদস্যের ‘সমন্বয়ক কমিটি’। কমিটিতে থাকেন ২৩ জন সমন্বয়ক ও ৪২ জন সহ-সমন্বয়ক। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন— সরকারকে তিনদিনের আল্টিমেটাম। না মানলে সারাদেশে ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ কর্মসূচি। ৯ জুলাই ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, আর ১০ জুলাই পূর্ণদিবস অবরোধ— এই ছিল তাদের পরবর্তী রূপরেখা।
‘আমরা সংবিধান দেখাচ্ছি, আদালত নয়’
আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমাদের আদালত দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা আপনাদের সংবিধান দেখাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীকেই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি কি মেধার পাশে দাঁড়াবেন, নাকি অন্য কিছুর।‘
রাজধানী ছিল কার্যত অচল
এদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ঢাকায় চলাফেরা করাই ছিল দুঃসাধ্য। শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, সায়েন্সল্যাব, চানখাঁরপুল প্রতিটি মোড়ে অবরোধ। ইডেন কলেজ, ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেদের অবস্থান জানান দেন গণজমায়েত ও অবরোধের মাধ্যমে। পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সচিবালয় পর্যন্ত মিছিল করে যান। ঢাকার প্রবেশমুখ— গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, মহাখালীতেও ছড়িয়ে পড়ে এই কর্মসূচি।
দেশব্যাপী অবরোধ
৮ জুলাই সকাল থেকেই রাজধানীর শাহবাগ, ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, বাংলামটর, ফার্মগেট, নীলক্ষেতসহ অন্তত ১২টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। শুধু তাই নয়— রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রংপুর, কুমিল্লা, বরিশাল থেকে শুরু করে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সাতক্ষীরা, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে একযোগে নেমে আসে দেশের তরুণ প্রজন্ম।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ জানান। শাবিপ্রবিতে সড়ক অবরোধ করে আগুন জ্বালিয়ে করা হয় প্রতীকী প্রতিরোধ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা জাতীয় পতাকা হাতে নেমে আসে সড়কে।
আন্দোলনকারীদের দাবি
- ২০১৮ সালের পরিপত্র অবিলম্বে পুনর্বহাল করতে হবে।
- সকল কোটা যৌক্তিক ও ন্যূনতম পর্যায়ে আনতে হবে।
- যোগ্য প্রার্থী না থাকলে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ দিতে হবে।
- একই কোটা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না।
- একটি দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে।
সামাজিক মাধ্যমে আন্দোলনের জোয়ার
ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার) এবং ইউটিউবে ‘বাংলা ব্লকেড’ হ্যাশট্যাগে লক্ষাধিক পোস্ট, ভিডিও ও লাইভ স্ট্রিমিং হয়। সাধারণ নাগরিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও প্রবাসীরাও এই আন্দোলনের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানান। অনেকেই একে ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলনের ‘নতুন সংস্করণ’ হিসেবে দেখতে শুরু করেন।
প্রশাসনের কৌশলী অবস্থান
সরকার বা পুলিশের পক্ষ থেকে সরাসরি দমন-পীড়নের কোনো চিত্র না থাকলেও সমন্বয়কদের উপাচার্য অফিসে ডেকে ‘সময়ক্ষেপণ’-এর অভিযোগ ওঠে। ব্লকেড শুরু হওয়ার আগেই নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও আবু বাকেরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয়সংলগ্ন লাউঞ্জে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিন ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ছিল বিকেলে ৩টা থেকে। সমন্বয়করা যাতে ঠিক সময়ে কর্মসূচিতে উপস্থিত হতে না পারে, সেই জন্যই আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকেন ডিজিএফআই’র কর্মকর্তা।