Wednesday 09 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খুলনায় বাড়ছে অপরাধ: ১০ মাসে ২৬ খুন, আতঙ্কে মানুষ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৯ জুলাই ২০২৫ ১০:০৮

প্রতীকী ছবি

খুলনা: খুলনায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। গত ১০ মাসে মেট্রোপলিটন এলাকায় ২৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও, প্রায়শই ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তঙ্কে রয়েছে জনগণ।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০শে জুন পর্যন্ত খুলনা মহানগরীতে ২৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

মাসভিত্তিক হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছরের আগস্টে ২টি, সেপ্টেম্বরে ১টি, অক্টোবরে ২টি, নভেম্বরে ৪টি এবং ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ ৬টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। চলতি বছরেও এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে; জানুয়ারিতে ২টি, ফেব্রুয়ারিতে ১টি, মার্চে ১টি এবং এপ্রিল, মে ও জুন মাসে ৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এই তথ্য খুলনার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

বিজ্ঞাপন

২৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মধ্যে দুটি মরদেহ নদীতে ভেসে আসায় সেগুলোর তদন্তের দায়িত্বে আছে নৌপুলিশ। বাকি ২৪টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ২২টির পেছনের ঘটনা খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। জড়িত আসামিদের গ্রেফতার করা হয়ছে। অবশিষ্ট দুটি মামলা এখনও তদন্তাধীন রয়েছে, তবে পুলিশ জানিয়েছে তদন্ত কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

২৬ জুন রাত ৯টার দিকে খুলনার রূপসা উপজেলার রাজাপুর গ্রামের পপুলার এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে সাব্বির (২৭) নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরও দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহত সাব্বির ও আহত দুজনই খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী ‘গ্রেনেড বাবু’ গ্রুপের সদস্য। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ৬টি গুলির খোসা, ৪ রাউন্ড তাজা গুলি, কিছু ইয়াবা এবং গ্রেনেডের মতো দেখতে একটি বস্তু উদ্ধার করা হয়।

২৬ জুন রাত ৮ টার দিকে খুলনা নগরীর হরিণটানা থানাধীন রাজবন্ধ এলাকার দক্ষিণ পাড়ায় বাবলু দত্ত (৫০) নামের এক ব্যক্তিকে গলা কেটে করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত বাবুল দত্ত দক্ষিণপাড়া এলাকার বসিন্দা অমূল্য দত্তের ছেলে।

২৬ জুন রাত সাড়ে ৯ টায় উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের রাজাপুর এলাকায় দুর্বৃত্তের ছোড়া গুলিতে মো. সাদ্দাম (৩৫) নামে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হন।

৮ এপ্রিল সকালে সন্ত্রাসী হামলায় আহত পলাশ (১৮) খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে ৭ এপ্রিল রাতে নগরীর জাতিসংঘ শিশুপার্কে আয়োজিত ঈদ মেলায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধের জেরে পলাশকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেটে আঘাত করে সন্ত্রাসীরা। এতে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

৩ এপ্রিল রাত সাড়ে আটটার দিকে ফুলতলা উপজেলার খুলনা-যশোর মহাসড়কের সুপার ব্রিকসের সামনে ফুলতলা উপজেলা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ আবুল বাশারকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা বোমা নিক্ষেপ করে। অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি।

২০ জানুয়ারি পুরাতন রেলস্টেশন এলাকায় ২১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মানিক হাওলাদারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৪ জানুয়ারি রাতে নগরীর তেঁতুলতলা মোড়ে সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও কুপিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্ণব কুমার সরকারকে হত্যা করে। ২৩ জানুয়ারি সকালে খুলনায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মন্টু শেখ (৪৫) নামে বিএনপির এক কর্মীর দুই চোখ ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে সন্ত্রাসীরা। দিঘলিয়া উপজেলার দক্ষিণ চন্দনীমহল মালোপাড়া নারদের দোকানের সামনে এ ঘটনা ঘটে। একইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সন্ত্রাসীর গুলিতে জিয়া প্রজন্ম দলের কেন্দ্রীয় নেতা ইকরাম হাওলাদার আহত হন। রূপসা উপজেলার ১ নম্বর আইচগাতি ইউনিয়নের ঠান্ডার বাগান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

২০২৪ সালের ২৯ নভেম্বর রাতে নগরীর টুটপাড়া এলাকায় গুলি ছুড়ে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আমিন মোল্লা বোয়িংকে গুরুতর আহত করে সন্ত্রাসীরা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়। গত ৩০ মার্চ নগরীর আরামবাগ এলাকার একটি বাড়িতে মধ্যরাতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।

২৬ মার্চ নগরীর পশ্চিম টুটপাড়া এলাকার কবি নজরুল ইসলাম সড়কের জুলহাসের চায়ের দোকানের সামনে মো. কামাল নামের এক যুবককে গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত করে সন্ত্রাসীরা। সে নগরীর মুক্তা কমিশনার কার্লভার্ট এলাকার মো. আব্দুল মালেকের ছেলে।

৩০ মার্চ রাতে খুলনার তিনটি স্থানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে দুটি রূপসা উপজেলার নৈহাটি ইউনিয়নের পূর্ব রূপসা এলাকায় ও একটি নগরীর রূপসা বেড়িবাঁধ রোডের বরফ কলের সামনে।

খুলনা নগরীর নিরালা এলাকায় বসবাস কারী মামুনুর রশীদ বলেন, বর্তমানে নগরীতে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া ওয়ে উঠেছে। প্রায়ই হত্যাসহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিন কোন না কোন এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, মানুষ নিহত হচ্ছে। এটা আসলে কাম্য নয়। আমরা আশা করি, আইনশৃঙ্খলা আগের অবস্থানে ফিরে আসবে।

মঙ্গলবার (৮ জুলাই) দুপুরে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) আয়োজনে গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন কেএমপি কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দার। কেএমপি কমিশনার সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।

এসময় পুলিশ কমিশনার জানান, বিগত ১০ মাসে মেট্রোপলিটন এলাকায় ২৬টি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে দুটি মরদেহ নদীতে ভেসে আসায় ওই দুটি হত্যাকাণ্ডের মামলা নৌপুলিশ তদন্ত করছে। বাকি ২৪ টির মধ্যে ২২টি হত্যার পেছনের ঘটনা মেট্রোপলিটন পুলিশ তদন্তের মাধ্যমে উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে ও আসামিদের আটক করা হয়েছে। বাকি দুইটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে, তবে তদন্তকাজে অগ্রগতি আছে।

তিনি জানান, মাদক বিক্রেতা, বাহক ও যারা খুলনার বাইরে থেকে মাদক নিয়ে আসে তাদের ওপর পুলিশের নজরদারি অব্যাহত আছে। গত সপ্তাহে হরিণটানা থানা এলাকা থেকে ১৯ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও নিয়মিত অভিযানে মাদকদ্রব্য উদ্ধার হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, ‘স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সন্তানদের সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে হবে। তারা যেন সন্ধ্যার পরে ঘরের বাইরে অযথা আড্ডা না দেয়, সেদিকে অভিভাবক-সহ সকলকে নজর দিতে হবে।’

পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, ‘খুলনা শহরে প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার ইজিবাইক চলাচল করে। ধারণা করা হয় এর প্রায় ৬০ শতাংশ প্রতিদিন বাইরে থেকে শহরে প্রবেশ করে। ইজিবাইকচালকরা ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় যানজটের কারণ হয়ে ওঠে। কেএমপির উদ্যোগে এ পর্যন্ত ছয় হাজার ৫০০ ইজিবাইকচালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বাকিদের তিন থেকে চার মাসের মধ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হবে। এছাড়া খুলনার সব ইজিবাইককে দুই রঙে বিভক্ত করে রঙ অনুযায়ী একদিন বাদে একদিন চলাচলের ব্যবস্থা করা বিষয়ে ভেবে দেখা যেতে পারে।’

সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মোহাম্মদ রাশিদুল ইসলাম খান, উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, উপপুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মো. আবু তারেক, উপ-পুলিশ কমিশনার (সিটিএসবি) আবুল বাশার মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, ও উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) সুদর্শন কুমার রায় উপস্থিত ছিলেন।

সারাবাংলা/এসআর

২৬ খুন খুন খুলনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর