ঢাকা: সময়টা ২০১৮ সাল। ভালোই কাটছিল মারিয়ার (ছদ্মনাম) দিনকাল। কিন্তু হঠাৎ করেই তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। অপহরণ হন পুলিশের হাতে। টানা ২৪ দিন গোপন বন্দিশালা বা আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন ২৫ বছর বয়সী এই তরুণী। আর এ ক’দিন তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয় রশিতে বেঁধে। কেড়ে নেওয়া হয় গায়ের ওড়নাও। এর পর পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠতেন পুলিশের পুরুষ কর্কমর্তারা। যাচ্ছেতাই বলে হাসাহাসিও করতেন। এমনকি নির্যাতনের ভয়াবহতায় নির্ধারিত সময়ের আগেই মাসিক (পিরিয়ড) শুরু হয় তার।
নির্মমতার এই বাস্তব চিত্র জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলের। মতের সঙ্গে অমিল, কিংবা বিরোধী ঘরানার মানুষকে তুলে নিয়ে এভাবেই নির্যাতন চালাতেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানাতেন তারা। প্রস্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক, নখের নিচে সুঁচ ঢোকানো, নখ উপড়ে ফেলা, যৌন অত্যাচারসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন। এমনই গা-শিউরে ওঠার মতো অনেক বর্ণনা উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে।
কমিশনের প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি অংশে ২৫ বছর বয়সী ওই তরুণীর ভয়ংকর নির্যাতনের কথাও তুলে ধরা হয়। ভুক্তভোগী নারী জানান, ২০১৮ সালে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর বন্দিশালায় ক্রুশবিদ্ধভাবে দু’দিকে দু’হাত বেঁধে ঝোলানো হয়। এক পর্যায়ে ভয়ানক অত্যাচার চালান পুরুষ কর্তারা।
তিনি বলেন, ‘বাঁধা অবস্থায় আমার মুখটি জানালার দিকে রাখতেন তারা। ওড়না আগেই কেড়ে নিতেন। জানালার দিকে মুখ থাকায় বাহিনীর অসংখ্য পুরুষ আমাকে এসে দেখতেন। আর বলাবলি করতেন ‘এতদিন এমন পর্দাই করছ, এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।’ এ ছাড়া, আমার মাসিক (পিরিয়ড) হওয়ার তারিখ অনেক দেরিতে ছিল। কিন্তু নির্যাতনের কারণে সঙ্গে সঙ্গে মাসিক হয়ে যেত। প্যাড চাইলেও তারা হাসাহাসি করত।’
শুধু এই তরুণীই নন, এমন বহু নিরীহ মানুষের ওপরও চালানো হয়েছিল নির্যাতন। তবে নারী-পুরুষের অত্যাচারের ধরন ছিল আলাদা। এমনই একজন ৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। যিনি একবছরেরও বেশি তথা ৩৯১ দিন আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন। প্রতিবেদনে তার কথাও তুলে ধরা হয়।
বন্দিশালায় থাকা বিভিন্ন সেলের সংকীর্ণতার বর্ণনা কমিশনকে জানান এই ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘আমাকে যে সেলে রাখা হয়েছিল, সেখানে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। মাঝে কোনো দেয়াল ছিল না। এতে আমরা ঘুমানোর সময় পুরো শরীর ওই প্যানের ওপর পড়ে থাকতো। ফলে ময়লা, প্রস্রাব বা মলের মধ্যেই আমাদের রাত কাটানো হতো।’
এই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘এসব সেল সংকীর্ণ হলেও সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিল। যার মাধ্যমে আমাদের কর্মকাণ্ড নজরে রাখতেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। সিসি ক্যামেরার কারণে টয়লেট ব্যবহারের সময় চরম অপমানবোধ হতো আমাদের। এমনকি নিরাপত্তা প্রহরীদের কারণে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারতাম না।’
কমিশনের প্রতিবেদনে ২০১০ সালে গুম হওয়া এক যুবকের ঘটনাও উঠে আসে। ওই যুবক প্রায় দেড় মাস গুম ছিলেন। তার বর্ণনাও খুবই লোমহর্ষক। এই যুবকের বর্ণনামতে, বন্দিশালায় তার পায়ে দু’টি ক্লিপ লাগানো হতো। এরপর বৈদ্যুতিক শক দিতেন বাহিনীর সদস্যরা। এতে সঙ্গে সঙ্গেই তার পুরো শরীর ফুটবলের মতো হয়ে যেত।
তিনি বলেন, ‘শক দেওয়ার সময় আমার শরীরটা যেন ফুটবলের মতো গোল হয়ে যেত। এভাবে আট-দশবার শক দেওয়া হয়। শকটা সর্বোচ্চ তিন-চার সেকেন্ড থাকতো। বৈদ্যুতিক শকের মধ্যেই আমাকে নানান প্রশ্ন করতেন তারা। এ ছাড়া, বেপরোয়াভাবে চার-পাঁচজন পেটাতেন।’
এই যুবক আরও বলেন, ‘পেটানো মধ্যেই দুই হাত ধরে ওই হুকের ওপর লাগানো হতো। এর পর কিছুতে সুইচ টিপলে অটোমেটিক আমার শরীরটা ওপরে উঠে যেত। ঠিক তখন আমার কাপড় খুলে গোপনাঙ্গে ফের একই হুক লাগিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন তারা। সুইচ দিলে মনে হতো আমার সব অঙ্গ পুড়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে গোশত পোড়ারও গন্ধ পেতাম।’
র্যাব-১০ এর হাতে গুম হওয়া এক ব্যক্তি নিজের সেই ভয়াবহতার কথা জানান কমিশনকে। তিনি বলেন, ‘গ্রিলের মধ্যে হাতকড়া পরিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। এতে বসতে না পারার কারণে পা ফুলে যেত। হাতের দাগ এখনও রয়েছে। এ ছাড়া, ওয়াশরুমে যেতে চাইলেও বাধা দিতেন তারা।’
এই ব্যক্তি বলেন, ‘হাতকড়া পরিয়ে দাঁড়ানো রাখা অবস্থাতেই একদিন আঙুলে সুঁচ ঢোকানো হয়। প্রথমে একজনে প্লাস দিয়ে আঙুলটা ধরেন। এর পর টেবিলের ওপর হাত রেখে আরেকজন সুঁচ ঢোকান। যার দাগও রয়ে গেছে। এমন নির্যাতনের সময় আমাকে বলা হয় ‘তুই কি আবদুল মুমিন না? জবাবে আমি বলি- স্যার আমি হাবিব।’
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক মতাদর্শে অমিল বা সরকারবিরোধী কোনো কথা বললেই লোকদের তুলে নেয়া হতো। এরপর দিনের পর দিন গোপন বন্দিশালায় আটকে রেখে নির্যাতন চালাতেন গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আর এই বন্দিশালা থেকে মুক্তি মিললেও দীর্ঘমেয়াদী ট্রমায় ভোগেন নির্যাতিতরা। অনেকে মানসিক চিকিৎসাও নিয়েছেন।
এছাড়া নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হতেন না নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ভুয়া মামলা দিয়ে ভুক্তভোগীদের অনেকের পরিবারকে নিঃস্বও বানিয়েছেন তারা। আইনি লড়াইয়ের পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচের মাধ্যমে পারিবারিক জীবনও ব্যাহত হয়েছে অনেকের। তবে আগের সরকারের আমলে বাহিনীর সদস্যদের এমন নৃশংস কাজে না লাগিয়ে দেশের মানুষের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় লাগানো প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন তারা।