ঢাকা: ১০ জুলাই ২০২৫। সারাদেশ থমকে দাঁড়ায় এক চরম বাস্তবতার সামনে। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশজুড়ে পালন করে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। ঢাকার শাহবাগ থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের দেওয়ানহাট, রংপুরের মডার্ন মোড়, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট, পাবনা কিংবা বরিশাল— বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে একইসঙ্গে জ্বলে উঠে প্রতিরোধের আগুন।
রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থীরা
শুধু ঢাকায়ই নয়, দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় এ কর্মসূচিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, তিতুমীর কলেজ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা, পাবনা, বরিশাল, দিনাজপুর— একটি জায়গাও বাদ যায়নি। কেউ রেললাইন অবরোধ করেছে, কেউ মহাসড়ক, কেউ মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে উচ্চারণ করেছে— ‘ন্যায়ভিত্তিক কোটা চাই।’
শুধু রাজধানীর মধ্যেই শিক্ষার্থীরা অবরোধ করে ২৫টিরও বেশি পয়েন্ট। শাহবাগ, বাংলামোটর, ফার্মগেট, মৎস্য ভবন, কারওয়ান বাজার, চানখাঁরপুল, গুলিস্তান, পল্টন, সায়েন্সল্যাব— সব জায়গায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানীসহ গোটা দেশ।
আদালতের অবস্থানে আন্দোলনকারীদের ঘোষণা
৯ জুলাই সকালেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা জারি করে। অর্থাৎ পুরনো নিয়মই বহাল থাকবে— যেখানে ২০১৮ সালের পরিপত্র অনুসারে কোটা তুলে নেওয়া হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানালেও আন্দোলনকারীরা মনে করেন, এটি শুধুই সময়ক্ষেপণ। সমন্বয়কদের বক্তব্য, ‘আমরা আর কোনো আশ্বাস চাই না। আমরা চাই সংসদে আইন করে যৌক্তিকভাবে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা বহাল রেখে অবশিষ্ট সম্পূর্ণ মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা হোক।’
নতুন কর্মসূচি
১০ জুলাই রাতেই পরবর্তী দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে বাংলাদেশের সর্বত্র সড়ক ও রেলপথে শিক্ষার্থীরা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন। বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে আমরা কর্মসূচি শুরু করব এবং শিক্ষার্থীরা সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ব্লকেড কর্মসূচি সফলভাবে পালন করবেন।’
এই অবস্থান কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে তা নির্ভর করছিল সরকারের প্রতিক্রিয়ার ওপর। এদিন আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। জনগণের ভোগান্তি হয় এমন কর্মসূচি প্রত্যাহার করাই উচিত।’ কিন্তু আন্দোলনকারীদের দাবি, ‘আদালত নয়, সংসদে আইন করে স্থায়ী সমাধান।’
‘বাংলা ব্লকেড’ গণঅভ্যুত্থানের সূচনা
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের একটি গৌরবময় অবস্থান রয়েছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, কিংবা কোটা সংস্কার আন্দোলন— প্রতিবারই ছাত্রসমাজ সামনের সারিতে ছিল। ২০২৪ সালেও ‘বাংলা ব্লকেড’ অনেকের কাছে তাই শুধু একটি কর্মসূচি নয়, বরং এটি গণঅভ্যুত্থানের নতুন অধ্যায়ের সূচনা।