Friday 11 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আসামি থেকে রাজসাক্ষী, ক্ষমা পাচ্ছেন কি মামুন?

রাশেদ মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১০ জুলাই ২০২৫ ২২:২৪ | আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৫ ০১:১১

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: ছিলেন আসামি। কিন্তু দায় কাঁধে নিয়ে হয়ে গেলেন রাজসাক্ষী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এমনই চমক দিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এমনকি আদালতে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে নিজের একসময়ের কর্তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। রাজসাক্ষী হওয়ায় সাবেক এই আইজিপি কী ক্ষমা পাবেন; এমন প্রশ্ন জেগেছে অনেকের মনে। তবে মাফ করা না করা আদালতের এখতিয়ার বলে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

টানা ক’দিনের মতো বৃহস্পতিবার সকালেও বৃষ্টি ঝরছিল। তবু নির্ধারিত সময়ে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ট্রাইব্যুনালে আনে পুলিশ। অনেকটা চুপচাপই ছিলেন তিনি। বেলা সাড়ে ১১টায় তাকে এজলাসে তোলা হয়। একা চেয়ারে বসে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিলেন। এর মাঝেই নিজের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু মিনিট কয়েক পরই আদালতকে বড় চমক দেন সাবেক এই পুলিশপ্রধান। আর ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এটিই প্রথম রাজসাক্ষীর ঘটনা।

বিজ্ঞাপন

এদিন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ পড়েন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। তখন অনেকটা ‘অনুতপ্ত’ ছিলেন চৌধুরী মামুন। এক পর্যায়ে তার বক্তব্য জানতে চান আদালত। ঠিক তখনই পকেট থেকে কাগজের টুকরো বের করে দীপ্ত কণ্ঠে নিজের সব দায় স্বীকার করেন তিনি।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার মামলায় জুলাই-আগস্ট গণহত্যাযজ্ঞের দায় নিয়ে রাজসাক্ষী হওয়ার কথাও জানান মামুন। বিচারকদের উদ্দেশে সাবেক এই আইজিপি বলেন, ‘আমি দোষ স্বীকার করছি। আমি স্বেচ্ছায় সত্য প্রকাশ করব। এ ছাড়া, এ মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত আমার জানা সব পরিস্থিতির কথা তুলে ধরব।’

গেল ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এর পরই তার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হয় আদালতে। তবে জুলাই হত্যাযজ্ঞের পেছনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি অন্যতম কুশীলবের ভূমিকায় ছিলেন চৌধুরী মামুন। অথচ নিজেই এখন সব দায় মেনে নিয়েছেন। রাজসাক্ষী হতে চাওয়া সাবেক এই আইজিপির আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত। একইসঙ্গে আসামি নন, রাজসাক্ষী হয়েই কারাগারে মামুন থাকবেন বলে জানান ট্রাইব্যুনাল।

মুহূর্তেই পাল্টে যায় গোটা দৃশ্যপট। এমনকি তার পর্যাপ্ত নিরাপত্তা চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ। এরই মধ্যে কারাগারে একক সেলে রাখা হয় মামুনকে। ট্রাইব্যুনাল থেকে তাকে সরাসরি নতুন সেলে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন এই আইনজীবী।

সাংবাদিকদের তাজুল ইসলাম বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যার ঘটনায় পলাতক আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী মামুনের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন মামুন। অভিযোগ পড়ে শোনানোর পর তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তখন তিনি নিজের দোষ স্বীকার করেন।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশের সাবেক এই মহাপরিদর্শক রাজসাক্ষী হতে চাওয়ায় নিরাপত্তার সংকট হতে পারে। এজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে প্রার্থনা করেছেন তার আইনজীবী। বিষয়টি নিয়ে যথাযথ আদেশ দেবেন ট্রাইব্যুনাল।’

রাজসাক্ষী হওয়ায় ক্ষমা পাবেন কি না? এমন প্রশ্নে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আসামি থেকে সাক্ষী হওয়ায় মামুনকে কারাগারে রাখা হবে নাকি জামিন দেওয়া হবে, সেটি নির্ধারণ করবেন ট্রাইব্যুনাল। আদালত চাইলে তাকে ক্ষমা করতে পারেন বা অন্য কোনো আদেশ দিতে পারেন।’

সূত্র বলছে, পুলিশের ২৯তম মহাপরিদর্শক ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তাকে এ পদে আসীন করেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাছের মানুষকে বসিয়ে নিজের হাত আরও শক্তিশালী করেছে বলে তখন অভিযোগ উঠেছিল সাবেক এই সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে। আর সেই অভিযোগ বাস্তবে রূপ নেয় চব্বিশের জুলাই-আগস্টে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার হুকুম যথাযথ পালন করেন চৌধুরী মামুন।

পুলিশপ্রধানের নির্দেশেই দেশজুড়ে হিংস্র আর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে পুলিশ বাহিনী। তাদের গুলিতে প্রাণ হারান অসংখ্য নিরীহ মানুষ। আর নিজের বাহিনীর নৃশংস এসব কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করতেন মামুনসহ অন্যরা। এমনকি শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে প্রাণঘাতী বা মারণাস্ত্র ব্যবহারেও অধীনস্তদের হুকুম দেন তিনি।

রাজসাক্ষী কাকে বলে

সাধারণত রাজসাক্ষী হন একজন আসামি। যিনি নিজের অপরাধ স্বীকার করেন। একইসঙ্গে বাকি অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য কিংবা সঠিক তথ্য তুলে ধরেন; যেন শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়া, রাজসাক্ষী মানে হলো রাজ্যের সাক্ষী। কেননা এ আইন প্রণয়নের সময় ‘রাজ্য প্রথা’ ছিল। তাই ‘রাজসাক্ষী’ বলা হতো। তবে বর্তমানে রাষ্ট্রের সাক্ষী বলা হয়।

সাধারণত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধের রহস্য উদঘাটন করা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে। আদালতকেও মামলা নিষ্পত্তি করতে বেগ পেতে হয়। কারণ আসামিরা মুখ খুলতে চান না। তখন রাজ

যা বলছে আইন

সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারা অনুযায়ী, একজন অপরাধী সংঘটিত অন্য সহযোগী অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি বলে বিবেচিত হতে হবে। দুষ্কমের্র সহযোগীর অসমথির্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দেওয়া হলে তা বেআইনি বলে গণ্য হবে না। এ ধারামতে, রাজসাক্ষীকে ক্ষমা প্রদশের্নর ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেন সাক্ষী হিসেবে আসামি ব্যবহৃত হতে পারেন।

একই আইনের ১৪৪ ধারামতে রাজসাক্ষীর একক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে শাস্তি দেওয়া আইনত যুক্তিসঙ্গত হবে না। কেননা অন্যান্য সহযোগী অপরাধীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকেন তিনি। তাই রাজসাক্ষীর মতো একজন বিশ্বাসঘাতক সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণে বেশ সতকর্তা অবলম্বন করেন আদালত। আর আসামির সংখ্যা বেশি হলে এমনভাবে সাক্ষ্য দিতে হবে যেন প্রত্যেক আসামির পৃথকভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘জুলাই গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন একজন রাজসাক্ষী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কেননা অপরাধ সংঘটনে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। উপরিমহল তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের বৈঠকে হওয়া পরিকল্পনায় মামুনও অংশ নিতেন বলে অভিযোগে আনা হয়।’

এ ছাড়া, তিনি জুলাই-আগস্ট ঘিরে সব গণহত্যার পেছনের পরিকল্পনা বা যা যা হয়েছে, সব বলতে পারবেন। তাই তার চেয়ে বড় সাক্ষী আর কেউই হতে পারে না। তবে অন্যান্য সাক্ষীও তার সাক্ষ্যতে সমর্থন দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিচারক বা আইনজীবীর কথায় রাজসাক্ষী হলে ভিন্ন বিধান রয়েছে। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় হলে সাজা কমানো বা মওকুফ করা উচিত বলে মনে করেন এই আইন বিশেষজ্ঞ।

তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো রাজসাক্ষীর সাজা কমানো বা মওকুফ করা একান্তই আদালতের এখতিয়ার। চাইলেই আদালত যেকোনো আদেশ দিতে পারেন। এ ছাড়া, রাজসাক্ষী হলে আদালতের সময় বাঁচে। এমনকি বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের অর্থ বাঁচাসহ হয়রানিও অনেকাংশে কমে যায়। তাই রাজসাক্ষীরা কিছুটা হলেও ছাড়া পান।’

সারাবাংলা/আরএম/পিটিএম

গণহত্যা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দায় স্বীকার রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর